প্রাচীনকালে মিশরীয়রা মৃত্যু নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলো। তারা ভাবতো ধর্মই মহাবিশ্বের চুড়ান্ত রহস্য আবিষ্কার করতে পারে। প্রকৃতিকে ভীষণ ভয় পেতো। তাই তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। প্রাথমিক অবস্থায় মিশরীয়রা মাটি, পানি, বৃষ্টি, আকাশকে ঈশ্বর হিসেবে ভাবতো।
শিকারীদের সব সময়ই বড় বড় পশুর সাথে যুদ্ধ করতে হতো। মিশরীয় চিত্রকলায় তাদের বিশ্বাসের প্রভাব পড়েছে। পশু, পশুর মাথা বা শিং দিয়ে ঈশ্বরকে চিত্রায়িত করা হয়েছে অনেক স্থানে।
মিশরীয় মিথ অনুযায়ী পৃথিবী এক আদিম সমুদ্রে ডুবে ছিলো। এই সমুদ্রের নাম নান’। নানের পৃষ্ঠদেশ বা উপরিভাগ বলে কিছু নেই। এই সমুদ্রের পানিতে কোন স্রোত ছিল না। সে আকারে ছিলো ডিমের মতাে।
পৌরাণিক কাহিনীতে নানই হলো প্রথম দেবতা, নানই সেই আদিম সমুদ্র অর্থাৎ পানি। মনে করা হয়, নীল নদই এই বিশ্বাসের কারণ। নীল নদের কারণেই মিশরীয়রা কৃষিকাজে সাফল্য পেয়েছিলো। তাই বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে পানির অপরিহার্যতা তারা বুঝতে পেরেছিলো। এ থেকেই হয়তো পানি থেকে প্রাণ সৃষ্টির ভাবনাকে অনুপ্রাণিত করেছিলো।
মিশরীয়রা আকাশকে ঈশ্বরী হিসেবে কল্পনা করত। আকাশ এক স্বর্গীয় সমুদ্র, যার পেটের ভেতরে সূর্য পাল তুলে ভেসে বেড়ায়। আকাশের নিচে শুয়ে আছে সমুদ্র, যার কেন্দ্রে আছে মাটির ঈশ্বর ‘গেব।
মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিলো, স্বর্গীয় গাভী থেকে প্রতিদিন সূর্য নামক সােনালী বাচ্চার জন্ম হয়। কোন সর্বগ্রাসী নারী তাকে রাতের বেলায় শুষে নেয় এবং প্রতিদিন ভােরে তার পুনর্জন্ম হয়।
আরেক মতে, স্বর্গের সমুদ্রে সূর্যদেবতা চিরস্থায়ীভাবে ভেসে থাকে না। সমুদ্রের কোন এক দ্বীপে তার বসবাস। সে মাটির ঈশ্বর গেব-এর অনুরােধে ঈগলের আকৃতিতে প্রতিদিন একটা করে ডিম পাড়ে। এই ঈগলের ডান চোখ সূর্য আর বাম চোখ ছিলো চাঁদ। চাঁদকে বলা হয়েছে সূর্যের ভাই এবং আকাশদেবতা ‘নুট’ -এর পুত্র ।
পৃথিবীর আংশিক অংশের রং লাল, যেখানে বাস করে বর্বর মরুবাসীরা। বাকি কালাে অংশটিই নীল উপত্যকার উর্বর ভূমি । আর সমুদ্র ও নীল নদ হচ্ছে মাটির তলদেশে অবস্থিত পৃথিবীর উৎস।
প্রাচীন মিশরে চারটি বৃহৎ ধর্মানুষ্ঠান কেন্দ্র হেলিওপোলীস, হারমোপোলীস, মেমফীস ও থিবীসের ধর্মীয় মতবাদ আলাদা ধরণের। এই চারটি মতবাদ সংক্ষেপে তুলে ধরছি-
হেলিওপোলীও মতবাদ:
এই মতবাদ অনুযায়ী, পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে নানের বর্জ্য থেকে ঈশ্বর আটুমের জন্ম হয়। পৃথিবীতে প্রথম পাহাড় সৃষ্টি করেন ঈশ্বর আটুম। সেই পাহাড়েই হেলিওপোলীসের মন্দির বানানো হয়। বন্যা থেকে মিশরীয়দের বাঁচানোর জন্য আটুম নীল নদের পানিকে পিছু হটিয়ে দেয়।
আটুমের প্রতীক ছিল ফিনিক্স পাখি। ফিনিক্স ওড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভােরবেলা সূর্য ওঠে। তাই এই পাখিই সূর্যরশ্মির প্রতিনিধি। পাশাপাশি সে গুবরে পােকার প্রতীক ধারণ করে। গুবরে পােকা ঘুরপাক খেতে খেতে নিজের সামনেই ডিম পাড়ে এবং এই ডিম থেকেই সৃষ্টিচক্রের শুরু।
এক সূত্র অনুযায়ী, আদি পাহাডগুলি আটুমের পুত্র শ্যু ও কন্যা তেফনাতকে সৃষ্টি করেছে। আবার অন্য সূত্র থেকে জানা যায়, আটুম বসবাস করে নানের জলে এবং সেখানেই সে তার পুত্র-কন্যাদের সৃষ্টি করে।
শ্যু ও তেফনাতকে পানির ভেতর থেকে বের করে নান এবং তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আটুমের চোখের। আটুমের একটাই চোখ এবং তিনি ইচ্ছা করলেই শরীর থেকে এই চোখকে আলাদা করে ফেলতে পারতেন।
শ্যু ও তেফনাত জন্মের প্রথম দিকে আটুমের কাছে থাকলেও নানের পানিতে অন্ধকারের কারণে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । আটুম তখন নিজের চোখকে পুত্র-কন্যার সন্ধানে পাঠালে তারা সেই চোখের সঙ্গে ফিরে আসে।
শ্যু এবং তেফনাতের সঙ্গে আবার দেখা হলে আটুম আনন্দে কেঁদে ফেলে। তার কান্না থেকেই মানুষের জন্ম। পুত্র ও কন্যা ফিরে আসায় আটুম নানের পানি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত হয় এবং পৃথিবী সৃষ্টি করে।
শ্যু ও তেফনাতের পুত্র ‘গেব’ হচ্ছে মাটি এবং কন্যা ‘নুট’ হচ্ছে— আকাশ। গেব ও নুটের চারজন সন্তান- আইসিস, ওসিরিস, নেফতিস ও শেথ ।
এক মতবাদ অনুযায়ী, আটুমের চোখকে কপালের ওপর বসিয়ে নেওয়া হত, যেখান থেকে এই চোখ সারা বিশ্ব শাসন করতে পারে। এই চোখকে আবার বর্ণনা করা হয়েছে ধ্বংসাত্মক ঈশ্বররূপে।
ফারাওরা এই বিশ্বাস থেকেই কপালে প্রতীক ব্যবহারের নিয়ম চালু করেছিলেন। ‘ক্ষমতা’ বোঝানোর জন্যই ফারাওরা এই প্রতীক ব্যবহার করতেন।
মেমফীয় মতবাদ:
খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ৩,০০০ সালে ফারাও মেনেসের উদ্যোগে আপার ও লোয়ার ইজিপ্ট এক হয়। সবাই মেমফীসকে সাদা দেওয়ালের শহর হিসেবে চিনতো।
পাথরে লেখা পৃথিবীর আদিতম নিদর্শন থেকে আমরা মেমফীয় মতবাদ সম্পর্কে জানতে পারি। এই পাথরকে বলা হয় ‘সাবাকা স্টোন’।
মেমফীয় মতবাদ হেলিওপােলীয় মতবাদের তুলনায় দুর্বোধ্য। এ নিয়ে আমরা জানতেও পেরেছি কম। সাবাকা পাথর থেকে জানা যায়, পিটাহ সমস্ত ঈশ্বরসহ পৃথিবীর সমস্ত ভালো কিছু সৃষ্টি করেছে। তার ক্ষমতা অন্যান্য ঈশ্বরের চেয়ে বেশি এটাও স্বীকৃত।
যেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান চর্চা হয়, পিটাহ সেখানেই ঈশ্বর প্রতিষ্ঠা করে। সে ঈশ্বরদের জন্য মন্দির, সমাধিও তৈরি করে।
পিটাহকে সিংহাসনের ওপর কল্পনা করা হয়েছে । মিশরীয় ঈশ্বরতত্ত্বের প্রাথমিক ধারা অনুযায়ী পিটাহ উর্বরতার ঈশ্বর। পিটাহ নিজেকে নান বলে ঘােষণা করে এবং আটুম ও নাউনেতকে জন্ম দেয় (নাউনেত হচ্ছে নানের নারী প্রতিমূর্তি)।
মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো মন ও বুদ্ধিবৃত্তির উৎসস্থল হচ্ছে হৃৎপিণ্ড। হেলিওপােলীসে পিটাহকে শহরের হৃদপিণ্ড এবং জিভ হিসেবে গণ্য করা হতো। পিটাহ এই ভূমির সৃষ্টিকর্তা, সেও নিজেও একসময় ছিলো ভূমি।
মেমফীয় মতবাদে, আটুমের তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো না। হোরাসকে হৃৎপিণ্ড ও থোটকে জিভ বলে ভাবা হতো। আটুম এই দুই রূপে বিভক্ত হয়েছিলো। হােরাস প্রাচীন সূর্যদেবতা আর থােট হলো চাঁদ ও স্বাধীনতার দেবতা।
হারমোপোলীয় মতবাদ:
হারমোপোলীয় মতবাদের অনুসারীরা দাবি করতো, এটাই বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রাচীন মতবাদ। হারমােপােলীয়দের ছিলো আট দেবতার দল। এই ঈশ্বরেরা হচ্ছে— নান এবং তার সঙ্গী নাউনেত, হাহ এবং তার সঙ্গী হাউহেত, কাব এবং তার সঙ্গী কাউকেত এবং আমােন ও তার সঙ্গী আমাউনেত।
এই আট ঈশ্বর একসাথে পৃথিবী সৃষ্টি করেন। কিছুকাল রাজত্ব করার পর সৃষ্টিকর্ম সমাপ্ত করেন এই আটজন। এরপর ঈশ্বরেরা মারা যান এবং প্রেতলােকে চলে যান। কিন্তু তাদের ক্ষমতা পৃথিবীতে থেকে যায়। এই ক্ষমতার ধারাবাহিকতায়ই নীলনদ বয়ে চলে, প্রতিদিন সূর্য ওঠে।
হারমাপোলীয় মতবাদে চারটি ধারণা লক্ষ্য করা যায়-
প্রথম ধারণা অনুযায়ী, এক স্বর্গীয় রাজহাঁস ডিম পেরেছিলো শুরুতে । এই ডিম পাড়ার শব্দে পৃথিবীর নীরবতা ভাঙে। ডিমের ভেতরে ছিল আলাের পাখি রা এবং বাতাস। আলোর পাখি রা-ই পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলো।
দ্বিতীয় ধারণা অনুযায়ী, প্রথমে সারস পাখি ডিম পাড়ে। এই সারস পাখি চাঁদ ও স্বাধীনতার ঈশ্বর থোটের প্রতিনিধি। থােট নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে এবং অষ্ট-ঈশ্বরের ভেতরে রয়েছে তার আত্মা।
তৃতীয় ধারণা অনুযায়ী, দুই সমুদ্রের জলে প্রতিদিন পদ্মফল ফোটে। পদ্মফুলের পাপড়ি খুলে গেলেই দেখা যায় ঐশ্বরিক শিশু ‘রা’ বসে আছে। এই মতবাদ, জল থেকে জীবন সৃষ্টির তত্ত্বকে সমর্থন করে।
চতুর্থ ধারণা অনুযায়ী, সমুদ্রের জলে পদ্মফুল ফুটলে একটি ঘুরতে থাকা গুবরে পােকা দেখা যায়, যেটি সূর্যের প্রতীক। তারপর গুবরে পােকাটি একটি বালকে পরিণত হয়। বালকটি কাঁদতে শুরু করে।
বালকটি ‘রা’-এর সন্তান। পদ্মফুলের পাপড়ি প্রতিদিন খােলে এবং বন্ধ হয়। তাই পদ্মফুল সূর্য দেবতাকে বহন করতে পারে।
নীলনদের স্রোতপ্রবাহ টিকিয়ে রাখা ও প্রতিদিন সূর্য ওঠানাের দায়িত্ব হচ্ছে অষ্ট ঈশ্বরের।
প্রত্যেকটি ধারণাই মিশরের উর্বরতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। দেখাই যাচ্ছে, সবগুলো মতবাদের সাথে ঈশ্বর নানের জলরাশির সম্পর্ক রয়েছে।
থিবীয় মতবাদ:
থিবীয় মতবাদ অনুযায়ী, থিবীস হচ্ছে প্রথম শহর। শহরটি তৈরি হয়েছিল পাহাড়ের ওপর। এই শহরের পথ ধরেই পৃথিবীর যাত্রা শুরু।
থিবীসেই আদি দেবতা নান জন্মগ্রহণ করেন। তাই এটি প্রথম ভূমি ও আদিম টিলা। থিবীসকে দেখেই পরবর্তীতে মানুষ অন্যান্য শহর নির্মাণ করে।
থিবীস মধ্য মিশরের এক শহর। এই শহরের প্রধান ঈশ্বর আমােন। আটুমের মতাে আমােনও নিজেকে সৃষ্টি করেছে।
থিবীয় মতবাদে সৃষ্টি সম্পর্কিত সবগুলি তত্ত্বই গ্রহণ করা হয়েছে।। আমোনের প্রথম প্রতিমূর্তিকে হারমােপােলীসে বলা হতাে ‘ওগদোয়াদ’ বা অষ্ট-ঈশ্বর।
মেমফীসের আদিম টিলায় তার পরবর্তী প্রতিমূর্তির নাম ছিল—তাতিনেন। তারপর আমােন পৃথিবী পরিত্যাগ করে রা’-এর মতাে স্বর্গে স্থায়ী হয়।
নানের জলের মাঝখানে পদ্মফুলের খােলা পাপড়ির ভেতরে দেবশিশুর প্রতিমূর্তিও সে গ্রহণ করে। ‘রা’ অথবা হােরাসের মতাে সে চোখ দিয়ে পৃথিবীকে আলােকিত করে।
আমোন চাঁদ, মানুষ ও সমস্ত ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। অষ্টঈশ্বরকে একসাথে করেছে। আমোনই নানকে অসাড় অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে পৃথিবীর যাত্রা শুরু করে।
থিবীয় যাজকেরা দাবি করত যে, তাদের শহরেই ওসিরিস জন্ম নিয়েছেন। ভূমির উর্বরতার ঈশ্বর হিসেবে ওসিরিস বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।
মিশরীয় মিথে পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে যা বলা হয়েছে, তা ভাবতে গেলে এই যুগে একটু খটকাই লাগে। তবে মনে রাখতে হবে, এই সবই মানুষের মৌলিক চিন্তার সূচনা যাত্রা। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা, জানার আগ্রহ করা, মতবাদ দেওয়া, পুরোনো মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন ধারণাকে নিয়ে আসার ফলেই বিজ্ঞানের জন্ম। তাই এই মতবাদগুলো ফেলে দেবার নয় একদমই।
তথ্যসূত্র:
- https://en.wikipedia.org/wiki/Egyptian_mythology
- https://www.ancient.eu/Egyptian_Mythology/
- http://www.egyptianmyths.net/memphis.htm
- https://en.wikipedia.org/wiki/Ancient_Egyptian_creation_myths
- https://en.wikipedia.org/wiki/Ogdoad_(Egyptian)
- মিশরীয় পুরাণ- মোস্তফা মীর
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন