আন্তর্জাতিক পুরস্কারগুলোর মধ্যে নোবেল পুরস্কার নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় ও সম্মানের। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, এই স্বপ্নের অর্জন স্বর্ণের নোবেল পদক লুকিয়ে ফেলেছিলেন কেউ। সত্যি বলতে লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু কেন? আজ শোনাবো সেই রোমাঞ্চকর বাস্তব গল্প।
কেন নোবেল পদক অদৃশ্য করার প্রয়োজন হয়েছিল?
অ্যাডলফ হিটলারের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নাৎসি জার্মানির অধিকর্তা হওয়ার পর হিটলার কিছু নির্মম, বিধ্বংসী ও অনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করেন। দুজন পদার্থবিদ ম্যাক্স ভন লুই ও জেমস ফ্রাঙ্ক। ভন লুই ক্রিস্টালের এক্স ডিফ্রাকশান করার জন্য ১৯১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান আর ফ্রাংক ১৯২৫ সালে নোবেল পান পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য।
তারা দুজনেই জার্মান হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে বন্দী করে তাদের মেডেল দুটো কেড়ে নেওয়ার জন্য নাৎসি বাহিনীকে আদেশ দেন হিটলার। এর কারণ ভন লুই ছিলেন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টির বিরোধী। তাই তাঁকে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। অপরদিকে জেমস ফ্রাঙ্ক ছিলেন জাতিতে ইহুদী। ফলে ইহুদী দমন তালিকায় তাঁর নামও উঠে এসেছিল। মেডেল দু’টো নাৎসিদের কবল থেকে বাঁচানোর জন্য তাঁরা বোরের উপর দায়িত্ব দিয়ে পালিয়ে যান। বোর নিজেও ১৯২২ সালে নোবেল পুরস্কার পান তবে তা তিনি নিলামে বিক্রি করে দেন ফিনল্যান্ডের দুর্গতদের জন্য টাকা তোলার উদ্দেশ্যে। পরে অবশ্য ক্রেতা তা ফেরত দেন যা এখন ড্যানিশ হিস্টোরিক্যাল মিউজিয়াম অব ফ্রেডিকবর্গে গেলেই দেখা যাবে।
যেভাবে নাৎসি সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা পেলো নোবেল পদক
এবার আসা যাক মূল গল্পে। কীভাবে নীলস বোর রক্ষা করলেন ভন লুই আর ফ্রাঙ্কের নোবেল দু’টোকে?
১৯৪০ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়। হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি বাহিনী অপ্রতিরোধ্য গতিতে ইউরোপের বড় বড় শহরগুলো একের পর এক দখল করে নিচ্ছে। এবার তাদের থাবা পড়লো ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। কোপেনহেগেনের প্রতিটি রাস্তায় রাস্তায় নাৎসি সৈন্যরা মার্চ করে বেড়াচ্ছে আর বাড়িঘর, প্রতিষ্ঠান আর বিজ্ঞানাগার লুট করে চলেছে। সাথে চলছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। তাদের পদধ্বনির সাথে বাড়ছে নীলস বোরের হৃদস্পন্দন ধ্বনি।
নীলস বোর ঐ মুহূর্তে আছেন ‘বোর ইন্সটিউট অব থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স’-এর ল্যাবে। হাতে সময় খুব কম। হয়তো এক ঘণ্টাও নেই। কিংবা কে বলতে পারে মিনিটখানেক পরেই হয়তো এসে হানা দেবে হিটলারের কুখ্যাত বাহিনী। অথচ তার আগেই বোরকে দুই দুইটা নোবেল পদক লুকিয়ে ফেলতে হবে। সম্ভব হলে সম্পূর্ণ অদৃশ্য করে দিতে হবে।
নোবেল পদকগুলো বানানো হয় ২৩ ক্যারট স্বর্ণ দিয়ে। খোদাইকৃত আর চকচকে বলে লুকিয়ে রাখা কঠিন। বেশ ভারীও বটে। এদিকে নাৎসীরা ঘোষণা দিয়েছে, জার্মানী থেকে কোনো ধরনের স্বর্ণই বের হতে পারবেনা। বিশেষ করে ১৯৩৫ সালে একজন জেলবন্দী শান্তিকর্মী নোবেল পাবার পর তাদের নোবেল বিদ্বেষ চরমে রূপ নেয়। যদি কোনোভাবে বোর ইন্সটিটিউটে এই মেডেলগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায় তবে সর্বোচ্চ শাস্তি ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যায় না।
নাৎসি বাহিনি যে তার ল্যাবরেটরিতে হানা দেবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না বোরের। তাছাড়া গত এক বছর ধরেই ইহুদিদের ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে বোর ইন্সটিটিউট। অনেক ইহুদিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অগ্রগণ্য। এসব তথ্য নাৎসিদের অজানা নয়। নীলস বোর নিজেও যে তাদের টার্গেট সেটাও স্পষ্ট। এখন তিনি এই মেডেল দু’টো নিয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
সেসময় বোর ল্যাবে গবেষক হিসেবে কাজ করতেন এক হাঙ্গেরিয়ান রসায়নবিদ। নাম জর্জ ডি হেভেসি। যিনি আর কয়েক বছর পরে নিজেই নোবেল পুরষ্কার পাবেন। তো তিনি বোরকে পরামর্শ দিলেন মেডেলগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলতে। বোর চিন্তা করে দেখলেন নাৎসিদের আচরণ অনুযায়ী তারা এই মেডেল পাবার জন্য সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখবে এমনকি বাগান, আশেপাশের খোলা জায়গাও বাদ দেবেনা। তাই এই পরামর্শ মানা গেলো না।
এবার হেভেসি রসায়নের দ্বারস্থ হলেন। রসায়নকে কাজে লাগিয়ে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার একটা উপায় খুঁজে পেলেন। তা হলো মেডেলগুলোকে দ্রবীভূত করে অদৃশ্য করে ফেলবেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমি এগুলো দ্রবীভূত করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। যখন আক্রমণকারী বাহিনী কোপেনহেগেনের রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল, তখন আমি ভন লুই এবং ফ্রাঙ্কের মেডেলগুলো দ্রবীভূত করতে ব্যস্ত ছিলাম।”
প্রক্রিয়াটির রাসায়নিক ব্যখ্যা
গলানোর কাজে কোনো সাধারণ মিশ্রণ ব্যবহার হয়নি। যেহেতু স্বর্ণ অনেক নিষ্ক্রিয় ধাতু, সহজে ক্ষয় হয় না, মেশেও না এমনকি দ্রবীভুতও হয় না। তাই এই কাজটা করতে হয়েছিল বিশেষ এক ধরনের মিশ্রণের সাহায্যে। মিশ্রণের নাম ‘একুয়া রেজিয়া’। বাংলায় ‘অম্লরাজ’। তিন ভাগ বা ৭৫% হাইড্রোক্লোরিক এসিড আর এক ভাগ বা ২৫% নাইট্রিক এসিড মিশিয়ে তৈরি করা হয় একুয়া রেজিয়া। হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও নাইট্রিক এসিড হচ্ছে খুবই শক্তিশালী এসিড। এদের জলীয় দ্রবণে প্রচুর পরিমাণ H+ আয়ন থাকে, যার ফলে এরা অধিক অম্লধর্ম প্রকাশ করে থাকে। এর ফলে এই দ্রবণ সোনার মতো নিম্ন সক্রিয় ধাতুকেও গলিয়ে দ্রবণে রুপান্তর করতে সক্ষম।
তবে এই প্রক্রিয়া খুবই ধীর। যেকোনো অনুপাতের হাইড্রোক্লোরিক এসিড আর নাইট্রিক এসিড কিন্তু স্বর্ণকে গলাতে পারেনা। এরজন্য ঠিক ৩ঃ১ অনুপাতেরই হাইড্রোক্লোরিক এসিড আর নাইট্রিক এসিড লাগবে। রাজঅম্ল বা একুয়া রেজিয়া দ্বারা প্লাটিনাম, ইরিডিয়াম, টাইটেনিয়াম, রুথেনিয়াম প্রভৃতি ধাতুকেও দ্রবীভূত করা যায়।
এখন নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জাগছে, কীভাবে কাজ করে রাজঅম্ল বা একুয়া রেজিয়া? এর রাসায়নিক ব্যখ্যা হচ্ছে এই যে, নাইট্রিক এসিড খুব শক্তিশালী জারক। এটি স্বর্ণকে দ্রবীভূত করে (Au3+) আয়নে পরিণত করে। আর হাইড্রোক্লোরিক এসিড দ্রবণে অনবরত ক্লোরাইড (Cl–) আয়নের যোগান দিতে থাকে। ক্লোরাইড আয়ন আবার স্বর্ণের আয়নের সাথে বিক্রিয়া করে টেট্রাক্লোরোঅয়েট (III) আয়ন তৈরি করে। হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সাথে এই বিক্রিয়াটা মূলত একটি সাম্যাবস্থার বিক্রিয়া যা পরে অধিক ক্লোরাইড আয়নের সাথে বিক্রিয়া করে ক্লোরোঅয়েট (AuCl4–) আয়ন উৎপন্ন করে। এভাবে দ্রবণ থেকে স্বর্ণের আয়ন অপসারিত হতে থাকে আর ক্লোরোঅরিক এসিডে পরিণত হয়।
বিক্রিয়াটি হচ্ছে-
Au + 3HNO3 + 4HCl → HAuCl4 + 3NO2 + 3H2O
Au (s) + 3NO3 (aq) + 6H+ (aq) → Au3+ (aq) + 3NO2 (g) + 3H2O (l)
Au3+ (aq) + 4Cl– (aq) → AuCl4– (aq)
অবশেষে দুজনে সফল হলেন। মেডেল দু’টো ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যেতে লাগলো। একটা সময় পরে সোনা পুরোপুরি মিশে গেল অ্যাকুয়া রেজিয়ায়। সোনার জল হলেও বর্ণ সোনালী নয়, বরং কমলা রঙের। এবার তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। হেভেসি সোনার জল পুরে ফেললেন একটি জারে। জারটি খুব সাবধানে ল্যাবের সবচেয়ে উঁচু শেলফে রেখে দিয়ে দুজন সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন।
যথারীতি নাৎসি সৈন্যরা হানা দিলো বোরের ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে। ল্যাবে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে কি না তা হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলো তারা। কিছু না পেয়ে অনেক জিনিস ভাংচুর, তছনছ করে দিয়ে গেল তারা। কিন্তু রহস্যে ঘেরা কমলা রঙের জারটি কেউ স্পর্শও করলো না। কমলা রঙের জলের আর কী দাম! এভাবেই অক্ষত রইলো নোবেল মেডেলের ৪৬ ক্যারট স্বর্ণ।
হেভেসি তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছিলেন, “ঘটনার সেই বিকেলটা ছিল শ্বাসরুদ্ধকর সময়। একে তো অনেক ভারী মেডেল ছিল, তার উপর আর স্বর্ণও সহজে গলতে চায় না। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে সময় যাচ্ছিলো আর স্বর্ণও ধীরে ধীরে বর্ণ হারিয়ে মিশ্রণে পরিণত হচ্ছিল। একসময় কমলা বর্ণের একটা মিশ্রণ পাওয়া গেল।”
পুনরায় মেডেলে রূপান্তর
পরবর্তীতে যুদ্ধ শেষের অনেক পরে হেভেসি দারুণ এক কাজ করলেন। তিনি পুরো প্রক্রিয়াটার বিপরীত পন্থা চালালেন। তিনি ওই মিশ্রণটাতে প্রথমে ইউরিয়া যোগ করলেন যাতে নাইট্রিক এসিড দ্রবণ থেকে দূরীভূত হয়।
6HNO3 + 5CO(NH2)2 = 8N2 + 5CO2 + 13H2O
এরপর এতে সোডিয়াম মেটা-বাইসালফেট যোগ করে বিক্রিয়া ঘটালেন যাতে কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণ পাওয়া যায়।
2HAuCl4 + 2NaHSO3 = 2Au + 4HCl + Na2SO4 + SO2
উল্লেখ্য, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড (H2O2) এবং সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড (NaOH) যোগ করেও বিপরীত বিক্রিয়া চালানো যায়। সবশেষে প্রাপ্ত উৎপাদককে গরম পানিতে ধুয়ে শুকিয়ে ধাতুতে পরিণত করার জন্য প্রস্তুত করা হয়।
যাইহোক, হেভেসি স্বর্ণগুলোকে আবার নিজের রূপে ফিরিয়ে আনলেন। ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে ঐ কাঁচা ধাতু তিনি পাঠিয়ে দেন সুইডেনের স্টকহোমে নোবেল কমিটির কাছে। তারা এই স্বর্ণকে আবার মেডেলে পরিণত করেন এবং দুই বিজ্ঞানীর কাছে ফিরিয়ে দেন যথাযথভাবে।
উল্লেখ্য, একুয়া রেজিয়া থেকে সোনা পুনরুদ্ধারের কাজটি নীলস বোরের সেজো ছেলে ‘অ্যাগেই বোর’ করেছিলেন বলে অনেক বিজ্ঞান ইতিহাস লেখকদের ধারণা। অ্যাকুয়া রেজিয়া থেকে সোনা উদ্ধারের দুটি সম্ভাব্য উপায় হচ্ছে, হয় সোডিয়াম মেটা-বাইসালফাইট অথবা ফেরাস সালফেট ব্যবহার করে সোনা আলাদা করা। অ্যাগেই বোর এ পদ্ধতি দু’টির যেকোনো একটি ব্যবহার করেছেন বলে ধারণা করা হয়।
ইতিহাসে নোবেল পুরস্কার জয়ীদের তালিকা দীর্ঘ হলেও এই রোমাঞ্চকর স্মৃতির কারণে ম্যাক্স ভন লুই আর জেমস ফ্রাঙ্কের অর্জিত নোবেল দু’টি তাদের নিজেদের কাছে একটু বিশেষ হয়েই থাকবে বটে।
References:
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com/admissions/live/
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন