ভিত্তিহীন কারণে দুশ্চিন্তার নামই হলো ফোবিয়া। ফোবিয়া থেকে যখন এমন কর্মকান্ড ঘটতে শুরু করে, যেটা নিজের বা অন্যের কাজে বা চলাফেরায় অসুবিধা সৃষ্টি করে, তখনই তাকে রোগ বলে। চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী একে ‘অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমান পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ এই ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত।
গত পর্বে আমরা ফোবিয়ার ইতিহাস এবং ফোবিয়ার প্রকারভেদ সম্পর্কে জেনেছিলাম। চলো আজকে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য জেনে আসা যাক!
আমরা অনেকেই কোনো কাজ করার আগে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ি। কাজটা কেমন হবে? ভাল হবে তো? আচ্ছা, সবার কি এটা ভাল লাগবে? কারো যদি পছন্দ না হয়, তখন? এরকম আরো অনেকরকম প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। কিন্তু যারা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে ভুগছে, তারা খুব সাধারণ থেকে সাধারণতর কাজ করার সময়েও দুশ্চিন্তায় ভোগে। বাসা থেকে বের হবে? এতেও ভয়। দোকানে যাওয়া দরকার? তাও ভয়ের কারণে যাবে না। এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা খুব জলদি প্যানিকড হয়ে যায়। তারা ঘামতে থাকে এবং তাদের বুকে ব্যথা শুরু হয়। তারা ঠিকমতো ঘুমাতেও পারে না। সাধারণত অতিরিক্ত চাপের কারণে এরকম হয়ে থাকে। সেটা পড়ালেখা থেকে শুরু করে পারিবারিক চাপ
ই হোক না কেন।
মানুষের মস্তিষ্কে অসংখ্য নিউরন রয়েছে। আর মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের নিউরোকেমিক্যাল। মানুষ চেষ্টা করে সবসময় স্বাভাবিক আচরণ করতে, আশেপাশের মানুষের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে। কিন্তু যখনই তার মস্তিষ্কের নিউরোকেমিক্যাল সঞ্চালনে তারতম্য ঘটে, তখনই আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফোবিয়া বংশগত, আবার অনেকক্ষেত্রে তা পরিবেশগত।
তবে মা অথবা বাবার মধ্যে ফোবিয়ার যেসব লক্ষণ ছিল, তা সন্তানের মধ্যে নাও থাকতে পারে। অনেকসময় কেউ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তখন তার আর পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ইচ্ছা থাকে না। এটাই তাকে আরো দুর্বল করে ফেলে। আর এই দুর্বলতাই তার স্বাভাবিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করবে।
ছোটবেলায় কেউ কোনো খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলে সেটা পরবর্তীতে সোশ্যাল ফোবিয়ায় পরিণত হয়। অনেক সময় দেখা যায় ছোটবেলায় কেউ হয়তো তার শিক্ষকের কাছে প্রচুর মার খেয়েছিল। পরবর্তীতে পড়ার সময় এটা সর্বক্ষণ তার মাথায় ঘুরতে থাকে। ফলে সে আর পড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না।
আরও পড়ুন:
ফোবিয়া: হরেক রকম মানুষের হরেক রকম ভয় (পর্ব ৩)
নামাজ পড়ার নিয়ম: কোন নামাজ কত রাকাত ও নামাজের ফরজ কয়টি?
আমাদের কাছে অতি পরিচিত ফোবিয়াগুলো হচ্ছে অন্ধকারে থাকার ভয়, নির্দিষ্ট কিছু প্রাণীর প্রতি ভয়, কোথাও যাওয়ার ভয়, অতিপ্রাকৃত জিনিসের প্রতি ভয় ইত্যাদি। তবে এগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য ধরনের ফোবিয়া রয়েছে,যা আমরা কখনো ভেবে পর্যন্ত দেখিনি!
সাইকোলজিস্টদের মতে বর্তমানে প্রায় ৪০০ ধরনের ফোবিয়া রয়েছে।
তোমরা কি জানতে চাও এমন কিছু ফোবিয়ার কথা, যেগুলো খুবই কমন এবং আমাদের অনেকের মধ্যেই থাকতে পারে? চলো তাহলে জেনে আসি!
- স্পেশাল ফোবিয়া: বিশেষ কোনো পরিস্থিতি, জায়গা বা নির্দিষ্ট কোনো জিনিসের প্রতি অতিরিক্ত ভয় থাকাকে স্পেশাল ফোবিয়া বলে।
- এগারোফোবিয়া: খোলামেলা জায়গায় যেতে ভয় পায়। ভীড়-ভাট্টা এড়িয়ে চলে।
- Arachnophobia (মাকড়সাভীতি): মাকড়সা নামক এই আটপেয়ে নির্বোধ প্রাণীটিকে আমরা সবাই কমবেশি ভয় পাই। না, এটা কোনো ফোবিয়া নয়। তবে, যারা মাকড়সাকে সামনে দেখে ভয় তো পায়ই, সেই সাথে ছবিতে বা টিভিতে দেখলেও আঁৎকে ওঠে, তাদের জন্য এটা ফোবিয়া তো বটেই! অবশ্য এটা খুবই কমন একটা ফোবিয়া। প্রতি ৩ জনের মধ্যে এক জন নারী এবং ৪ জনের মধ্যে এক জন পুরুষের Arachnophobia আছে। পারতপক্ষে সব মাকড়সা আমাদের জন্য ক্ষতিকারক না হলেও প্রায় ৩৫,০০০(!) প্রজাতির মধ্যে মাত্র ১২ রকমের মাকড়সা আমাদের আসলেই ক্ষতি করতে পারে। এসব মাকড়সার মধ্যে মারাত্মক বিষাক্ত পদার্থ থাকে।
National Institute of Mental Health (NIMH)-এর এক সমীক্ষা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১০ জন মানুষ ফোবিয়ায় আক্রান্ত। আর এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ উচ্চতাভীতি এবং মাকড়সাভীতিতে আক্রান্ত!
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
Personal Fitness
-
- Ophidiophobia (সাপের প্রতি ভয়): গ্রীক শব্দ ‘Ophis’ যার অর্থ হলো সাপ। এই ফোবিয়ার ফলে মানুষ শুধু সাপ নয়, অন্যান্য সরীসৃপকেও ভয় পেয়ে থাকে।
- Acrophobia (উচ্চতাভীতি): অবাক করা তথ্য হলেও এটা সত্যি যে, পৃথিবীর প্রায় ২৩ মিলিয়ন মানুষের উচ্চতাভীতি রয়েছে (তোমার মধ্যেও আছে কি?)! এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা উঁচু বিল্ডিং, সেতু, টাওয়ার- এগুলো এড়িয়ে চলে। অনেকসময় তারা যখন উঁচু কোনো জায়গা থেকে নিচে তাকায়, তখন তাদের হাত-পা কাঁপতে থাকে এবং প্রচণ্ড ঘামতে থাকে। অনেক সময় টেনশনে তাদের হার্ট এট্যাকও হয়ে যেতে পারে! আমার সারা নামের একটা ফ্রেন্ড আছে, যে কিনা দোতালা বাসার ছাদে দাঁড়ালেও ভয় পায়! অনেককেই বাজি ধরে যে উঁচু বিল্ডিংয়ের সাইডের দেয়াল ঘেষে হাঁটতে দেখেছি। এরকম বাজি ঠাট্টাচ্ছলেও কখনো ধরা উচিত না। কেননা, একে তো এটা অত্যন্ত বিপদজনক কাজ, তার উপর কারো উচ্চতাভীতি থাকলে এর ফল হবে খুবই ভয়াবহ!
- Aerophobia (ওড়ার ভয়): ইউএসএর প্রায় ৮ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্লেনে উঠতে ভয় পায়! এদের মধ্যে বেশিরভাগ ভয় পায় তাদের প্লেন ক্রাশ করতে পারে, এইভেবে। বাদবাকিরা প্লেন হাইজ্যাকড হওয়ার ভয় পায়।
- Cynophobia (কুকুরকে ভয় পাওয়া): এটা হলো সেই ফোবিয়া,যেটা আমার মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে আছে। আমার আম্মু পর্যন্ত আমার এই সমস্যা নিয়ে চিন্তিত! ছোটবেলায় যাদের একবার কুকুর কামড়েছে, তাদের সাধারণত এই সমস্যাটা হয়ে থাকে। এই ভয়টা আসলেই খুব ট্রমাটিক, কারণ এটা একদম প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাওয়ার পরেও থেকে যায়। এটা এমন সমস্যা যেটা সেই ব্যক্তির জীবনের অনেক বড় একটা অসুবিধা হয়ে দাঁড়াবে। এই রোগের কারণে ব্যক্তি সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে ভয় পায়, যেখানে কুকুর আছে। যার কারণে সে বাসা, স্কুল, কলেজ, অফিস বা বাইরে বের হওয়ার সময় মুশকিলে পড়ে যায়।
- Astraphobia (বাজ পড়ার ভয়): যারা এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত, বাজ পড়ার সময় তাদের হার্টবিট বেড়ে যায়, তারা দুই হাত দিয়ে তাদের কান চেপে রাখে। অনেকসময় দৌড়ে কোনো সরু জায়গায় বসে পড়ে। কিংবা বাথরুম অথবা চাদরের নিচে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। তুমি যদি এস্ট্রাফোবিয়ায় আক্রান্ত কাউকে আজকের আবহাওয়ার খবর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো, তারা হড়হড় করে তোমাকে সব বলে দেবে। কারণ, এরা বৃষ্টি-বাদল এতই ভয় পায় যে বাসা থেকে বের হবার সময় আবহাওয়া সংবাদ দেখতে ভুল করে না!
- Ablutophobia (পরিষ্কার করার ভয়): ল্যাটিন ভাষায় ‘ablutere’ শব্দের মানে হলো ‘to wash off’। গোসল করা থেকে শুরু করে হাত ধুতেও তাদের ভয় লাগে। সাধারণত ইউরোপিয়ান দেশগুলোর নর-নারীদের মধ্যে এই ফোবিয়ার লক্ষণ দেখা যায়। আমরা সবাই রাণী এলিজাবেথের কথা জানি, যিনি নাকি মাসে একবার গোসল করতেন!
- Acousticophobia ( শব্দভীতি): ‘Acoustico’ শব্দের অর্থ হলো শোনা। যেকোনো প্রকার আওয়াজ যেমন: বাঁশির, হর্ন, মানুষের চিৎকার- ইত্যাদি আওয়াজ শোনার কারণেই এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির হার্টবিট বেড়ে যায় এবং মুখ শুকিয়ে যায়। তারা ঘর থেকে একদমই বের হতে পারে না বলা যায়।
- Algophobia (ব্যাথার ভয়): ছোটবেলায় আমরা সবাই খেলতে গিয়ে অহরহ ব্যথা পেয়েছি। গাছে উঠতে গিয়ে, সাইকেল চালাতে গিয়ে, দৌড়ানোর সময়। এমনকি বড় হওয়ার পরেও আমরা টুকটাক ব্যথা পাই। তাই বলে নিশ্চয়ই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি না। তবে Algophobia-র ফলে মানুষ ব্যথা পেতে পারে বলে, কোনো কাজই করতে চায় না। সাধারণত একদম ছোট্ট শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের এই ফোবিয়া বেশি থাকে।
- Agyrophobia (রাস্তা পারাপারের ভয়): এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সড়ক, মহাসড়ক অথবা যেকোনো রাস্তা পারাপার করতে ভয় পায়। Agyrophobia শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ gyrus থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় চলমান যানবাহন বা রাস্তায় ভয় পেয়ে ঘোরাঘুরি করা। এটি কারো হলে তার জন্য ঘর থেকে বের হওয়া বেশ কষ্টসাধ্য।
- Anthropophobia (মানুষের সাথে মেশার ভয়): এদেরকে একদিক দিয়ে অন্তর্মুখী বলা যায়। তবে অন্তর্মুখী মানুষ কখনো কারো সাথে কথা বলতে ভয় পায় না, তারা অন্যদের থেকে নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখে। কিন্তু যাদের মধ্যে Anthropophobi রয়েছে, তারা অন্যের সাথে মেশা দূরে থাক, কথাই বলতে পারে না। এমনকি দরকার হলেও না।
- Atychiphobia (অকৃতকার্য হওয়ার ভয়): আমরা বেশিরভাগ মানুষই মনে হয় এই ফোবিয়াতে আক্রান্ত! আমাদের সবার মধ্যেই অকৃতকার্য হওয়ার ভয় থাকে, সবচেয়ে বেশি থাকে স্কুল-কলেজের পরীক্ষার সময়! তবে যাদের মধ্যে আসলেই এই ফোবিয়া আছে, তারা অকৃতকার্য হওয়ার ভয়ে কোনো কাজই করতে চায় না।
- Autophobia (একাকীত্বের ভয়): সাধারণত ৩০ এর বেশি বয়সী ব্যক্তিরা এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়। তখন তাদের মনে হয় যে তাদেরকে সাহায্য করার আর কেউ নেই।
- Telephone Phobia (টেলিফোন ব্যবহার করার ভয়): সম্ভবত আমাদের মায়েরা বেশ খুশি হতেন আমরা এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত হলে! ১৯৯৩ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীর ২.১ মিলিয়ন মানুষ টেলিফোন ফোবিয়াতে আক্রান্ত। সাধারণত কলার কোনো খারাপ সংবাদ আনলে, প্রাংক কল করলে কিংবা হুমকি-ধামকি দিলে, মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে টেলিফোন ফোবিয়ার অস্তিত্ব দেখা যায়।
- Tryoanophobia (ইনজেকশনের ভয়): ছোটবেলায় তো আমরা সবাই ইনজেকশন লাগাতে ভয় পেতাম, বিশেষ করে টিকা দেওয়ার সময়! আমাদের মা আমাদেরকে শক্ত করে চেপে ধরতো, আর ডাক্তার আংকেল বলতো, “এই যে মামনি, বেশি ব্যথা লাগবে না! মনে হবে একটা পিঁপড়া কুটুস করে কামড়ে চলে যাবে।” আমরা কান্না করতেই এত ব্যস্ত থাকতাম যে কখন ইনজেকশন দেওয়া হয়ে গেছে, তা নিজেরাই টের পেতাম না! কিন্তু এটা তো ছোটবেলার গল্প। বড় বেলাতেও অনেকজনের ইনজেকশনের প্রতি ভয় দূর হয় না। যার ফলে তারা ডাক্তার কিংবা ডেন্টিস্টদের কাছ থেকে দূরে থাকে।
এই লেখাটির অডিওবুকটি পড়েছে ফাবিহা বুশরা
আমাদের কোর্সগুলোর তালিকা:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Communication Hacks by Ayman Sadiq and Sadman Sadik
- Communication Secrets by Ejazur Rahman
- Presentation & Public Speaking by Ayman Sadiq
- চাকরি জীবনের প্রস্তুতি by Solaiman Shukhon
- Negotiation Skills by Ejazur Rahman
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে ভিজিট করুন: www.10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন