পুরোটা পড়ার সময় নেই ? ব্লগটি একবার শুনে নাও !
বাবা-মায়ের শিক্ষকতার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। তখন মনে হত, কবে যে বড় হব! তখন আমার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবন মানেই ছিল ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে আড্ডা দেয়া, গান করা, মঞ্চে নাটক দেখা, আর প্রায়শই খোলা আকাশের নিচে জনপ্রিয় সব ব্যান্ডের কন্সার্টে রাতভর গান শোনা। এর মাঝে যদি কোন সৃজনশীল বা অন্য কোন প্রজেক্টে কাজ করা যায়- তাহলে তো আরও মজা। তাই দিনভর অনেক জল্পনা-কল্পনা করতে ভালোই লাগত!
আমি যখন ক্লাস নাইনে, তখন একদিন জানতে পারি ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলুর কথা। কানাডার এই বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে কিছু অনন্য গুণ দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ হয়ে উঠেছে সেটা জানার পর থেকে স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমিও হয়েছি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন। সেই স্বপ্নকে তাড়া করে একদিন পরিবার আর বন্ধুদের পিছনে ফেলে পাড়ি দিয়ে ফেললাম সাড়ে আট হাজার মাইল, পড়তে আসলাম ওয়াটারলুতে।

ওরিয়েন্টেশনের প্রথম দিনে পরিচিত হতে হল ডর্মের অন্যান্য সদস্যদের সাথে। সবাই আমার মত নতুন – ওরা শুধু কানাডার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছে তাই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষও আছে। তাই সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে যাওয়ার পরেও নিজেকে খাপছাড়া মনে হল না। সেই প্রথম দিনে পরিচয় হওয়া মানুষগুলো এখন আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের কয়েকজন। আমি যেমন আমার বন্ধুদের পরিবেশ, সংস্কৃতি নিয়ে শিখেছি, ওরাও আমাকে নিয়ে শিখেছে।
ডর্মের ক্যাফে তে বিভিন্ন রকম খাবার পাওয়া যায়, কিন্তু কদিন আর বার্গার বা বিদেশী ঢঙে অল্প একটু ভাত আর সবজি খাওয়া যায়? আমি একেবারে ভেতো বাঙালি, তাই পেট ভরে ঠিকই কিন্তু মন ভরে না। একদিন আমার এক বন্ধু খবর আনল যে ক্যাম্পাসের এক মাথায় একটা বাংলাদেশী দোকান আছে। শুনে আমার বিশ্বাসই হল না, ভাবলাম ভুল দেখেছে। দল বেঁধে গিয়ে দেখি ঘটনা সত্যি!
আমার বন্ধুরা বিরিয়ানীর এমনই ভক্ত হয়ে গেল যে এখন আমার বলতে হয় না, ওরা প্রায়ই নিজে থেকে বলে, “চল বিরিয়ানী খেতে যাই!” ডর্মে থাকার পালা শেষ করে বন্ধুদের সাথে অ্যাপার্টমেন্টে থাকা শুরু করার পর থেকে অবশ্য রান্নাটা নিজেকেই করে খেতে হয়। দেশে থাকতে চা/কফি বানানো ছাড়া কিছু করতাম না, কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্য টুকিটাকি শিখতেই হল। এখানে বাজার করা বেশ সহজ, এবং আমি আবিষ্কার করলাম রান্না করা ব্যাপারটা তেমন একটা খারাপ না! এত কিছুর পরেও পহেলা বৈশাখের সকালে তাড়াহুড়া করে একটা ডিম ভাজি খেয়ে বাসা থেকে বের হতে হতে হঠাৎ অসম্ভব মন খারাপ হয়ে যায়।
রান্নার প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলা জরুরি, সেটা হচ্ছে আমাদের স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা। দেশে থাকতে দেখতাম আমার বেশিরভাগ সহপাঠীর বাসার কোন কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। সবার বাবা-মা চাইতেন ছেলেমেয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করুক, যেটা অবশ্যই ঠিক। কিন্তু পাশাপাশি নিজের কাজ নিজে করতে পারাটাও অনেক বড় যোগ্যতা। নিজের ঘরটা গুছানো, কাপড় গুছানো, পরিচ্ছন্ন থাকা, এগুলো জানা যে কত দরকার সেটা একা একা থাকা শুরু করার পর অনুভব করা যায়। এদেশে কিন্তু নিজের বাথরুমটাও নিজেকে পরিস্কার করতে হয়। কোন কাজকেই কেউ ছোট করে দেখে না।
আমি বেশ ভাগ্যবান, আমাকে ছোটবেলা থেকেই এটা শিখানো হয়েছে। বাসায় থাকতে রান্না না করলেও নিজের কাজগুলো আমি নিজেই করতাম। এজন্যই হয়ত আমার এসব নিয়ে তেমন কোন কষ্ট হয়নি। আরেকটা দরকারি জিনিস হল বাজেট করতে জানা। নিজের বাসার বাইরে গেলে সবাইকেই মাসে একটা নির্দিষ্ট টাকা নিয়ে চলতে হয়। হিসাব করার অভ্যাসটা আগে থেকে থাকলে মাসের শুরুতে ভাল খেয়ে আর মাসের শেষে না খেয়ে থাকতে হয় না, সে আমি চিটাগাং থাকি বা ওয়াটারলুতে।
স্কুল-কলেজ জীবনের তুলনায় বরং এখনই পড়ার চাপটা সবচেয়ে বেশি
এখানে একটা ফাটাফাটি ব্যাপার হচ্ছে নিরাপত্তা। আমি রাত এগারোটা পর্যন্ত লাইব্রেরিতে পড়ে একা বাসায় যেতে পারি, যেটার কথা দেশে থাকতে ভাবাও যেত না। খামখেয়ালিপনা চাপলে সব বন্ধুরা মিলে ভোর চারটায় রেস্টুরেন্টে খেতে চলে যেতে পারি, আর গরমের দিনে গভীর রাতে মাঠে শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা দেখতে পারি। সাবধানের মার নেই তাই অপরাধের হার মোটামুটি শুন্য হওয়ার পরও এখানে নিয়মিত টহল দেয় ক্যাম্পাস পুলিশ। ভাবতে ইচ্ছা করে যে এই নিরাপত্তাবোধটা একদিন আমার নিজের দেশেও পাওয়া যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর আড্ডা, সিনেমা দেখা, ঘুরে বেড়ানো, নতুন নতুন জিনিস শেখা, অনেক কিছুই তো হল – কিন্তু আসল জিনিস্টাই যে বাকি রয়ে গেল। এমনিতেই এখানে পড়াশোনার ব্যাপারে আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যাপার হচ্ছে ইচ্ছেমত ইলেক্টিভ নেয়ার সু্যোগ – ইকোনমিক্সের ছাত্রী হয়েও আমি সমানতালে ক্লাসিকাল মিথলজি, ইটালিয়ান কালচার, এসব নিয়ে কোর্স নিয়েই যাচ্ছি। যাই শিখি ভাল লাগে!
তবে আরেকটা জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, এখানে সবাই প্রচন্ড মেধাবী, কাজেই এদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাকেও অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। ক্লাসে বেশিরভাগ সময় অ্যাটেনডেন্সের ঝামেলা থাকে না, কিন্তু এর মানে এই না যে ইচ্ছা মত ক্লাস ফাঁকি দেয়া যায়। ক্লাস ফাঁকি দিলে ক্ষতিটা আমারই – কারণ ক্লাস লেকচার মিস করা মানেই পড়াশোনায় পিছিয়ে যাওয়া।
চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে এখানে প্রত্যেক কোর্সের শিক্ষক প্রতি সপ্তাহে ক্লাসের বাইরে একটা নির্দিষ্ট সময় ছাত্রদের দিতে বাধ্য। পড়া নিয়ে যেকোনো প্রশ্ন থাকতে সেই সময়ে গিয়ে করা যায়। দ্বিতীয়ত, টিচাররা ইচ্ছামত যেমন তেমন ক্লাস নিলেই হয় না। টার্মের শেষে কোর্স এভালুয়েশন থাকে, যেখানে ছাত্ররা নিজের নাম প্রকাশ না করেই তাদের ভাল লাগা মন্দ লাগা বলতে পারে।

শিক্ষকরা যেমন খাটা-খাটনি করে আমাদের পড়ান, আমাদের কাছেও সেরকম ভাল ফলাফল প্রত্যাশা করেন। অতএব মাঝে মাঝে কাজের চাপ অনেক বেশিই হয়ে যায়, আর আমার সহ্য ক্ষমতার পরীক্ষাটাও ভালভাবে নিয়ে নেয়। স্কুল-কলেজ জীবনের তুলনায় বরং এখনই পড়ার চাপটা সবচেয়ে বেশি।
পড়ালেখা আর কাজের চাপ যখন অনেক বেশি হয়ে যায়, অথবা মাইনাস ২০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় যখন ঠান্ডা বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে হেটে হেটে ক্লাসে যেতে হয়, তখন হঠাৎ হঠাৎ করে মনে হয়, কেন এত কষ্ট করছি? নিজের বাসায় থেকে, চারপাশে প্রিয়জনদের রেখে, নিজের শহরে পড়াশোনা করলে কি খুব একটা খারাপ হত? তখন ভাবি প্রিয় মানুষ আবদ্দুল্লাহ আবু সায়ীদের একটা কথা– “মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।“ বিরাট স্বপ্ন দেখার সাহসটা যখন করেই ফেলেছি, আর ভাগ্যবানের মত সেটা বাস্তবায়ন করার সুযোগও পেয়ে গেছি– তখন হাল ছেড়ে না দিয়ে সুযোগটা কাজে লাগাতেই হবে!
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com/admissions/live/
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন