পৃথিবী, আমাদের আবাসস্থল, অন্য যেকোনো গ্রহ থেকে ভিন্ন। কারণ পৃথিবীই মহাবিশ্বের একমাত্র জায়গা, যেখানে রয়েছে প্রাণের সঞ্চার। গঠন প্রণালী অনুসারে আমাদের পৃথিবী সৌরজগতের চারটি কঠিন গ্রহের অন্যতম। সৌরজগতে পৃথিবীর অবস্থান, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আকার-আকৃতি এবং আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গঠনের জন্য একমাত্র পৃথিবীতেই রয়েছে প্রাণের অস্তিত্ব। তাই এই ব্লগে আলোচনা করবো পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গঠন, বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গঠন উপাদান এবং সবশেষে পৃথিবীর প্রধান ভূমিরূপগুলো নিয়ে।
পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ গঠন
জন্মের শুরুতে পৃথিবী ছিলো একটি উত্তপ্ত গ্যাসপিণ্ড। এই গ্যাসপিণ্ড ক্রমে ক্রমে ঠান্ডা হয়ে ঘনীভূত হয়। এই সময় পৃথিবীর ভারী উপাদানগুলো কেন্দ্রের দিকে জমা হতে শুরু করে। আর হালকা উপাদানগুলোকে তাদের ভরের তারতাম্য অনুযায়ী নিচ থেকে উপরে স্তরে স্তরে জমা হতে থাকে। পৃথিবীর এই স্তরগুলোর মধ্যে উপরের স্তরকে বলা হয় অশ্বমণ্ডল, আর অশ্বমণ্ডলের উপরের অংশ হলো পৃথিবীর ভূত্বক।
ভূত্বক
পৃথিবীর সবচেয়ে ওপরের কঠিন শিলা দিয়ে গঠিত স্তরকে ভূত্বক (Crust) বলা হয়। ভূত্বক হলো পৃথিবীর বাইরের দিকের একটি পাতলা আবরণ, যা পৃথিবীর আয়তনের ১% এরও কম অংশ জায়গা দখল করে রয়েছে। ভূত্বকের পুরুত্ব গড়ে ২০ কিলোমিটার। ভ‚ত্বক বিভিন্ন প্রকার শিলা ও খনিজ উপাদানে গঠিত।
ভূত্বকের পুরুত্ব
ভুত্বকের পূরুত্ব গড়ে ২০ কিলোমিটার, যা ভূঅভ্যন্তরের অন্যান্য স্তরের তুলনায় সবচেয়ে কম। আবার মহাদেশের তলদেশে ভূত্বক গড়ে ৩৫ কিলোমিটার এবং সমুদ্রের তলদেশে গড়ে মাত্র ৫ কিলোমিটার।
ভূত্বকের উপাদান
ভূত্বক বিভিন্ন প্রকার শিলা ও খনিজ উপাদান দ্বারা গঠিত। পৃথিবীর ভূত্বকে পাওয়া উপাদানের মধ্যে অক্সিজেন ও সিলিকন অন্যতম। অক্সিজেন ও সিলিকন ছাড়াও পৃথিবীর ভূত্বকের অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, টাইটানিয়াম ও হাইড্রোজেন ইত্যাদি।
পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ গঠনের ৩টি অংশ
পৃথিবীর অভ্যান্তরীন গঠন ৩টি অংশে বিভক্ত। সেই ৩টি অংশ হলো –
১) অশ্মমণ্ডল: সাধারণভাবে ভূপৃষ্ঠের উপরের অংশ থেকে ভূঅভ্যন্তরের দিকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লঘু ধাতুর সংমিশ্রণে গঠিত স্তরটিকে অশ্মমণ্ডল বলা হয়।
২) গুরুমণ্ডল: অশ্মমণ্ডলের নিচের প্রায় ২,৮৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ব্যাসল্ট শিলা দিয়ে গঠিত পুরুস্তরকে গুরুমণ্ডল বলা হয়।
৩) কেন্দ্রমণ্ডল: গুরুমণ্ডলের নিচ থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত স্তরটিকে কেন্দ্রমণ্ডল বলা। এ স্তরটির প্রায় ৩৪৮৬ কিলোমিটার পুরু।
পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ গঠন উপাদান: শিলা ও খনিজ
ভূত্বকের প্রধান গঠন উপাদান হলো শিলা। ভূতত্ত্ববিদগণের মতে দুই বা তারচেয়ে বেশি খনিজ পদার্থ নিয়ে শিলা গঠিত হয়। ভূত্বক বিভিন্ন ধরনের শিলা নিয়ে গঠিত, আর এই প্রত্যেক ধরনের শিলার রয়েছে নিজ নিজ আলদা বৈশিষ্ট্য। যেমন- কিছু কিছু শিলা কাদার মতো নরম আবার কোনোটা গ্রানাইট পাথরের মতো শক্ত। তবে এই সব ধরনের শিলাই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে ।
শিলার প্রকারভেদ
শিলার উৎপত্তি ও গঠনে অনুসারে শিলা প্রধানত তিন প্রকার। যথা:
১) আগ্নেয় শিলা
২) পাললিক শিলা
৩) রূপান্তরিত শিলা
এবার বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক, এই তিন ধরনের শিলা সম্পর্কে –
১) আগ্নেয় শিলা: পৃথিবী সৃষ্টির আদিম সময় থেকে যে সব শিলা শীতল ও ঘনীভূত হয়ে কঠিন আকার ধারণ করেছে তাদেরকে আগ্নেয় শিলা বলা হয়। যেমন: গ্রানাইট, ব্যাসল্ট ইত্যাদি।
২) পাললিক শিলা: পলি সঞ্চিত হয়ে যে সব শিলা গঠিত হয়েছে তাদেরকে পাললিক শিলা বলা হয়। এসব শিলায় পলি সাধারণত স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়। বেলেপাথর, কয়লা, চুনাপাথর, কাদাপাথর, কেওলিন পাললিক শিলার উদাহরণ।
৩) রূপান্তরিত শিলা: আগ্নেয় শিলা ও পাললিক শিলা যখন প্রচণ্ড চাপ, উত্তাপ ও রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে রূপ পরিবর্তন করে নতুন রূপ ধারণ করে তাকে রূপান্তরিত শিলা বলা। রূপান্তরিত শিলার একটি উদাহরণ হলো মার্বেল।
পৃথিবীর বাহ্যিক গঠন: পৃথিবীর প্রধান ভূমিরূপ
পৃথিবীর উপরিভাগের যে বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপসমূহ আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান তাদেরকেই পৃথিবীর বাহ্যিক গঠন বলা হয়।
পৃথিবীর প্রধান ভূমিরূপ (The Main Landforms of the Earth)
ভূপৃষ্ঠ পৃথিবীর সব স্থানে সমান নয় । আকৃতি, প্রকৃতি ও গঠনগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বেশ কিছু পার্থক্য আছে। ভূমির এই আকৃতি ও গঠনগত বৈশিষ্ট্যকেই ভূমিরূপ বলা হয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও আকৃতি অনুযায়ী পৃথিবীর সমগ্র ভূমিরূপকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো-
(১) পর্বত,
(২) মালভূমি ও
(৩) সমভূমি।
পর্বত (Mountains)
সমুদ্রের তলদেশ থেকে প্রায় ১,০০০ মিটারের বেশি উঁচু সুবিস্তৃত, শৃঙ্গযুক্ত, খাড়া ঢালের শিলাময় স্তূপকে পর্বত বলা হয়। পর্বতের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় কয়েক হাজার মিটার হতে পারে। পর্বতের ভূপ্রকৃতি উঁচু-নিচু, ঢাল খুব খাড়া এবং সাধারণত চূড়াবিশিষ্ট হয়।
পর্বতের প্রকারভেদ (Classification of mountains)
উৎপত্তিগত বৈশিষ্ট্য ও গঠনপ্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে পর্বত প্রধানত চার প্রকার । যথা-
(১) ভঙ্গিল পর্বত (Fold Mountains)
(২) আগ্নেয় পর্বত (Volcanic Mountains)
(৩) চ্যুতি-স্তূপ পর্বত (Fault block Mountains)
(৪) ল্যাকোলিথ পর্বত (Dome / Laccolith Mountains)
মালভূমি (Plateau)
পর্বতের থেকে নিচু, কিন্তু সমভূমির থেকে উঁচু খাড়া ঢালযুক্ত ঢেউ খেলানো বিস্তীর্ণ ভূমিকে মালভূমি বলা হয়। মালভূমির উচ্চতা কয়েকশত মিটার থেকে শুরু করে কয়েক হাজার মিটার পর্যন্ত হতে পারে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ মালভূমি পামির মালভূমির গড় উচ্চতা ৪,৫০০ মিটারের (১৪,৮০০ ফুট) অধিক। পামির মালভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মালভূমি হওয়ায় একে পৃথিবীর ছাদ বলা হয়।
মালভূমির প্রকারভেদ (Classification of Plateaus)
অবস্থানের ভিত্তিতে মালভূমি তিন ধরনের হয়ে থাকে। যথা-
(১) পর্বতমধ্যবর্তী মালভূমি (Intermontane Plateau),
(২) পাদদেশীয় মালভূমি (Piedmont Plateau) ও
(৩) মহাদেশীয় মালভূমি (Continental Plateau)
সমভূমি (Plains)
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অল্প উঁচু মৃদু ঢালবিশিষ্ট ভূমি সমভূমি নামে পরিচিত। বিভিন্ন ভূপ্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যেমন: নদীর স্রোতধারা, হিমবাহ ও বায়ুর ক্ষয় ও সঞ্চয়ক্রিয়ার কারণে সমভূমির সৃষ্টি হয়ে থাকে। মৃদু ঢাল ও স্বল্প বন্ধুরতার জন্য সমভূমি বসবাস, কৃষিকাজ ও রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য খুবই উপযোগী। আর এই কারণে সমভূমিতে সবচেয়ে ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে।
সমভূমির প্রকারভেদ (Classification of Plains)
উৎপত্তির ধরনের ভিত্তিতে সমভূমি প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথা-
(১) ক্ষয়জাত সমভূমি (Erosional Plains) ও
(২) সঞ্চয়জাত সমভূমি (Depositional Plains)
প্রশ্নমালা
পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গঠন, ৯ম-১০ম শ্রেণির ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ের একটি গূরুত্বপূর্ন অধ্যায়। প্রতি বছর এস. এস. সি. পরীক্ষায় এই অধ্যায় থেকে প্রশ্ন আসে। তাই ছোট্ট একটি পরীক্ষা দিয়ে নিজের প্রস্তুতি যাচাই করে নিন –
কোন খনিজ দ্বারা গুরুমণ্ডল গঠিত?
গুরুমণ্ডল (Barysphere) হলো পৃথিবীর অভ্যন্তরের মাঝের স্তর। অশ্মমণ্ডলের নিচের প্রায় ২,৮৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ব্যাসল্ট শিলা দিয়ে গঠিত পুরুস্তরকে গুরুমণ্ডল বলা হয়।
জীবদেহ থেকে উৎপন্ন পাললিক শিলা কোনটি?
পলি সঞ্চিত হয়ে যে সব শিলা গঠিত হয়েছে তাদেরকে পাললিক শিলা বলা হয়। বেলেপাথর, কয়লা, চুনাপাথর, কাদাপাথর, কেওলিন পাললিক শিলার উদাহরণ।
ম্যাগমা ঠাণ্ডা হয়ে কোন শিলায় পরিণত হয়?
পৃথিবীর সর্বোচ্চ মালভূমি কোনটি?
পৃথিবীর সর্বোচ্চ মালভূমি পামির মালভূমির গড় উচ্চতা ৪,৫০০ মিটারের (১৪,৮০০ ফুট) অধিক। পামির মালভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মালভূমি হওয়ায় একে পৃথিবীর ছাদ বলা হয়।
পৃথিবীর উপরের স্তরকে কী বলে?
সাধারণভাবে ভূপৃষ্ঠের উপরের অংশ থেকে ভূঅভ্যন্তরের দিকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লঘু ধাতুর সংমিশ্রণে গঠিত স্তরটিকে অশ্মমণ্ডল বলা হয়।
তথ্যসূত্র:
- ভূগোল ও পরিবেশ, ৯ম-১০ম শ্রেণি (২০২২)
- ভূগোল ও পরিবেশ – পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গঠন | SATT ACADEMY
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- সরকারি চাকরি প্রস্তুতি বেসিক কোর্স
- সরকারি চাকরি পরীক্ষা মডেল টেস্ট
- ব্যাংক জবস কোর্স
- ব্যাংক জবস প্রশ্ন সমাধান + মডেল টেস্ট কোর্স
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারেন এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন