জে কে রাওলিং: কোটি হৃদয় জয় করে নেয়া লেখিকার গল্প!

জে কে রাওলিং, কী চিনতে পারলেন না? হ্যারি পটার তো দেখেছেন মনে হয়, আর না দেখলেও পড়েছেন কিংবা হ্যারি পটারের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। জে কে রাওলিং হচ্ছেন সেই জনপ্রিয় কল্পকাহিনী হ্যারি পটার সিরিজের রচয়িতা, যার মাধ্যমে তিনি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। যা তাঁকে বিশ্বজুড়ে এনে দিয়েছে অনেক সম্মান ও জনপ্রিয়তা। কিন্তু তাঁর এই সফলতার পেছনের গল্পটা কিন্তু খুব একটা সুখের ছিল না। জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত তাঁকে অনেক কঠিন সময়ের মুখোমুখী হতে হয়েছে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। তবুও তিনি তাঁর স্বপ্নের পেছনে ছুটে গেছেন। বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরও তিনি হাল ছাড়েন নি, চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর জীবনের সংগ্রাম ও সফলতার পেছনের সেই গল্পটা নিয়েই আজকের এই লেখা।
 
 
জে কে রাওলিং এর জন্ম ৩১ জুলাই ১৯৬৫ সালে, ইংল্যান্ডের দক্ষিণে গ্লুসেস্টারশায়ারের ছোট্ট একটি শহরে। তাঁর বাবা পিটার রাওলিং ছিলেন একজন এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার আর মা অ্যান রাওলিং ছিলেন একজন সায়েন্স টেকনিশিয়ান। রাওলিংয়ের বয়স যখন ২৩ মাস, তখন তাঁর ছোটবোনের জন্ম হয়। কিছুটা বড় হওয়ার পর থেকেই ছোটবোন তাঁর কাছে প্রতিদিন গল্প শুনতে চাইতো। ছোটবেলায় রাওলিং তাই অনেক গল্প লিখে ছোটবোনকে পড়ে শোনাতেন।
তাঁর অবশ্য লিখতে ভালোই লাগতো। ছোটবেলা থেকে তাঁর কেবল একটিই স্বপ্ন ছিল, তিনি সবসময় শুধু একটি কাজই করতে চেয়েছেন- সেটি হচ্ছে উপন্যাস লেখা। কিন্তু তাঁর এই ব্যাপারে তাঁর বাবা-মা’র মোটেও কোনোরকম কোনো সমর্থন ছিল না। তাঁর এই স্বপ্নটি তাদের কাছে ছিল একদম ছেলেমানুষি একটি ব্যাপার। সেজন্যই একসময় তারা তাঁকে বাধ্য করেন ডিগ্রি অর্জন করতে। ইংরেজি নিয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও বাবা-মা’র সমর্থন না থাকায় পরে বাধ্য হয়ে তিনি ভর্তি হন আধুনিক ভাষা বিভাগে কিন্তু শেষমেশ এই বিষয় নিয়েও তিনি আর পড়েন নি। চলে গিয়েছিলেন ক্লাসিকস বিভাগের করিডোরে এবং শেষপর্যন্ত পড়ালেখা করেন ফ্রেঞ্চ আর ক্লাসিকসে। তারপর ১৯৮৬ সালে তিনি গ্র্যাজুয়েট হন এবং চলে আসেন লন্ডনে। লন্ডনে গিয়ে তিনি সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করার জন্য প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
 
১৯৯০ সালে একদিন তিনি ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে যাচ্ছিলেন পাতাল ট্রেনে করে। ট্রেনটিতে যাত্রীদের প্রচন্ড ভিড় ছিল আর সেই ট্রেনেই তাঁকে অতিবাহিত করতে হয়েছিল দীর্ঘ চার ঘন্টা। তখন সেই অবস্থাতেই তিনি চিন্তা করছিলেন নতুন কোনো লেখা নিয়ে। আর তখনই তাঁর মাথায় আসে ‘হ্যারি পটার’ গল্পের ধারণা। তাঁর কল্পনার জগতে উঁকি দেয় এতিম এক ছেলে। যে কিনা জানেই না যে, সে বিষ্ময়কর জাদুকরি ক্ষমতাধর একটি ছেলে। ঠিক ওই সময় থেকেই তিনি লেখা শুরু করে দিলেন হ্যারি পটার গল্পের এতিম সেই ছেলে হ্যারিকে নিয়ে। কিন্তু তারপর তাঁর মা মারা গেলে, তিনি কিছুটা ভেঙে পড়েন। যার প্রভাব পরে তাঁর লেখাতেও।
 
একসময় এসে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ইংরেজির শিক্ষক হবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ, ইংরেজীর শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে পাড়ি জমান পর্তুগালে। তিনি রাতে ইংরেজি ক্লাস নিতেন আর দিনে লেখালেখি করতেন। সেখানে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় পর্তুগিজ এক সাংবাদিকের সাথে। পরিচয় হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই, ১৯৯২ সালে তারা বিয়ে করেন এবং ১৯৯৩ সালে জেসিকা নামে তাদের একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু জেসিকার জন্মের অল্পকিছুদিনের মধ্যেই স্বামীর সাথে নানারকম সাংসারিক ঝামেলা শুরু হয় রাওলিংয়ের। জেসিকার বয়স যখন মাত্র চার মাস তখনই রাওলিং ও তাঁর স্বামী আলাদা হয়ে যান।
 
 
মেয়েকে নিয়ে রাওলিং তখন স্কটল্যান্ডে এসে তাঁর বোনের কাছাকাছি বসবাস শুরু করেন। তখন রাওলিংয়ের জীবনে শুরু হয় সবচেয়ে কষ্টের অধ্যায়। তখন তাঁর না ছিল কোনো চাকরি, না ছিল আয়ের কোনো উৎস। পরিবার বলতে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তখন তিনি বিশাল শহরে বলা চলে একাই হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে তখন অনেক বেশি দুঃসহ, অসহায় সময় পার করতে হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। তারপরও তিনি হাল ছাড়েন নি, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।
 
তার কিছুদিন পর থেকে, স্কটল্যান্ডের এডিনবরার এক ক্যাফেতে বসে তিনি আবারো টুকটাক লেখালেখি শুরু করেন। ছোট্ট মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে তখন থেকেই দিনের পর দিন লেখা চালিয়ে গেছেন তিনি। এডিনবরার ক্যাফেগুলো সাক্ষী হয়ে আছে সেই সব সময়ের। অবশেষে ১৯৯৫ সালে তিনি শেষ করেন হ্যারি পটার সিরিজের তাঁর প্রথম বই ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার্স স্টোন’। কিন্তু প্রকাশক? বইটি প্রকাশ করার জন্য তো প্রকাশক লাগবে। তখন তিনি বিভিন্ন প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠাতে থাকেন। কিন্তু প্রথমে কোনো প্রকাশকই বইটি ছাপতে রাজি হন নি। প্রকাশকদের ধারণা ছিল বইটি ছেপে তারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
 
 
প্রায় একবছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর,পাণ্ডুলিপি হাতে প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে মিললো প্রকাশক। আপনি জানলে অবাক হবেন, প্রায় ১২ জন প্রকাশক তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর সাফল্যের মুখ দেখেছিল ‘হ্যারি পটার’। শেষপর্যন্ত ব্লুমসবারি প্রকাশনী তাঁর বইটি ছাপাতে রাজি হয়। ব্লুমসবারি প্রকাশনীর চেয়ারম্যানের আট বছরের মেয়ের বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টারটি পড়ে বেশ ভালো লাগায় ব্লুমসবারি প্রকাশনী রাওলিংকে দেড় হাজার পাউন্ড অগ্রীম দিয়ে প্রকাশ করতে চায় তাঁর প্রথম বই ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার্স স্টোন’। প্রথম প্রকাশে বইটির এক হাজার কপি ছাপা হয়। যার মধ্যে প্রায় ৫০০ কপি বই-ই বিক্রি করা হয় বিভিন্ন স্কুল, কলেজের লাইব্রেরিতে।
 
 
এই হ্যারি পটার বইটি প্রথম প্রকাশের পর শিশু কিশোরদের বইয়ের দুনিয়ার এনেছিল এক অভিনব পরিবর্তন। এর আগে ইংরেজি শিশু সাহিত্যে অন্যান্য সিরিজ জনপ্রিয় থাকলেও হ্যারি পটার বাজারে এসে জনপ্রিয়তার সংজ্ঞাটাই যেন বদলে দিয়েছিল। বইটি প্রকাশের মাত্র পাঁচ মাস পরেই সেটি জিতে নিয়েছিল সেরা শিশুসাহিত্যের পুরস্কার।
এরপর ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে স্কলাস্টিক প্রেস আমেরিকায় বইটি প্রকাশ করে। কিন্তু বইটির নাম পরিবর্তন করে, স্কলাস্টিক প্রেস আমেরিকার সংস্করণে বইটি প্রকাশ করে “হ্যারি পটার এন্ড দ্য সরসারার্স স্টোন” নামে।
 
তারপর ১৯৯৮ সালে তাঁর দ্বিতীয় বই “হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অফ সিক্রেটস” প্রকাশিত হয় এবং আবারো পুরস্কার জিতে নেয়। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় বই “হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজনার অফ আজকাবান”। তাঁর তৃতীয় বইটি বের হওয়ার পর, হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম এই তিনটি বই-ই একসাথে দখল করে নিয়েছিল নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার তালিকার প্রথম তিনটি জায়গা। আর তিনি গড়ে ফেলেন পরপর তিন বছর একই পুরস্কার জেতার রেকর্ড। সেইসাথে পরিচিতি পেয়ে যান একজন বড় লেখক হিসেবে।

ঘরে বসে Spoken English

কোর্সটি করে যা শিখবেন:

  • জব ইন্টারভিউ, ভাইভা, প্রেজেন্টেশন, দেশি-বিদেশি ক্লায়েন্ট মিটিং, কলিগদের সাথে আলাপচারিতা, পাবলিক স্পিকিং, অপরিচিত কারো সাথে কথা শুরু করা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইংরেজিতে কথা বলা
  •  
     
    ২০০০ সালে হ্যারি পটারের চতুর্থ বই “হ্যারি পটার এন্ড দ্য গবলেট অফ ফায়ার” প্রকাশিত হয়। আর বইটি প্রকাশের পর প্রথম ৪৮ ঘণ্টায় বিক্রি হয় প্রায় ৩ মিলিয়ন কপি! তারপর প্রকাশিত হয় হ্যারি পটার সিরিজের ৫ম বই “হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য অর্ডার অফ দ্য ফিনিক্স” এবং ষষ্ঠ বই “হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য হাফ-ব্লাড প্রিন্স”।
    ২০০৭ সালের ২১ জুলাই বাজারে আসে তাঁর লেখা হ্যারি পটার সিরিজের সপ্তম বই। আর বইটি প্রকাশের পর প্রথম দিনেই বিক্রি হয়ে যায় প্রায় ১১ মিলিয়ন কপি। হ্যারি পটার সিরিজের প্রতিটি বই-ই সাফল্য লাভ করেছিল আগেরটার চেয়ে অনেক বেশি। হ্যারি পটার সিরিজের মোট সাতটি বই আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৪৫০ মিলিয়ন কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। বইয়ের পাশাপাশি এই হ্যারি পটার সিরিজের চলচ্চিত্রও কিন্তু সমান জনপ্রিয়!
     
     
    ইতিহাসে লেখকদের মধ্যে তিনিই প্রথম শতকোটি ডলারের মালিক হয়েছেন। পৃথিবীর সবথেকে ধনী লেখক এর কথা বলতে গেলে এখনো তাঁর নামটি উঠে আসে সবার আগে। সানডে টাইমস ম্যাগাজিনের ২০১৭ সালের ধনীদের তালিকার হিসেব অনুযায়ী রাওলিং এর মোট সম্পদের পরিমান প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।
     
     
    আপনারা জানেন নাকি জানি না, জে কে রাওলিং কিন্তু তাঁর আসল নাম নয়, তাঁর ছদ্মনাম। আসলে তাঁর নাম জোয়ান রাওলিং। কিন্তু প্রকাশকেরা যখন তাঁকে একজন মহিলার লেখা বই কম বিক্রি হতে পারে এমনটি জানায় তখন তিনি, তাঁর মূল নাম জোয়ান রাওলিং এর পরিবর্তে জে কে রাওলিং ছদ্ম নামটি ব্যবহার করেন। আর তাঁর মূল নামের সাথে কোনও মধ্যবর্তী নাম না থাকলেও তিনি ছদ্ম নামের সাথে ‘K’ অক্ষরটি যোগ করেন তাঁর দাদী ক্যাথরিনের সম্মানে।
     
     
     
    জে কে রাউলিং এর প্রথম বইটি প্রকাশের পর থেকেই বিভিন্ন বইয়ের জন্য তিনি গড়েছেন অনেক রেকর্ড, পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। হ্যারি পটার ছাড়াও তিনি লিখেছেন অনেক গল্প আর সিরিজ। আর তাঁর লেখার মাধ্যমে তিনি জয় করে নিয়েছেন কোটি মানুষের হৃদয় সেইসাথে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। আর সেজন্যই জে কে রাওলিং এখনো তরুণ পাঠকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় একজন লেখিকা!
     
     
    ২০০৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি অনুপ্রেরণা জাগানো একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। যেখানে তিনি তাঁর সমাবর্তনের পরের একুশ বছরে জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো সকলের সামনে তুলে ধরেন।

    ১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com


    আমাদের কোর্সগুলোর তালিকা:


    ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি অনলাইন ব্যাচ ২০২৩

    দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঘরে বসেই দেশসেরা শিক্ষকদের সাথে যুক্ত হও ইন্টারেক্টিভ লাইভ ক্লাসে, নাও ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির সম্পূর্ণ সিলেবাসের ?তে? প্রস্তুতি!