সপ্তাশ্চর্যের বিস্ময়ের ভিড়ে অন্যান্য বস্তুর তালিকার মত স্থান করে নিয়েছে পৃথিবীর সাতটি প্রাকৃতিক বিস্ময়। আদিকাল থেকেই পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরণের আশ্চর্য স্থানের খোঁজ পাওয়া যায়। তাই পৃথিবীর মনোরম সৌন্দর্যের বর্ণনার ক্ষেত্রে মাত্র সাতটি আশ্চর্যের কথা উল্লেখ করা কখনও যথেষ্ট হবে না। কিন্তু তবুও স্বীকৃত তালিকার মধ্যে যে জায়গাগুলো স্থান পায়, সে জায়গাগুলোর নাম-ই আগে উচ্চারিত হয়। সিএনএন কর্তৃক প্রস্তুত বহু তালিকার মধ্যে এটি একটি। চলুন জেনে নেয়া যাক, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যসমূহ।
১। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ
‘V’ – আকৃতির নদী উপত্যকা ক্রমশ খুব গভীর ও তীর খুব খাড়া হলে, তাকে গিরিখাত (Gorges) বলে। গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রবাল প্রাচীর। অস্ট্রেলিয়ার উত্তর পূর্বে অবস্থিত কুইন্সল্যান্ডের সমুদ্র তীরবর্তী প্রবাল সাগরে অবস্থিত। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ প্রায় ৯০০টি ছোট বড় দ্বীপ এবং ৩০০০-এরও বেশী প্রবাল প্রাচীর নিয়ে গঠিত। প্রায় ২০০০ কি.মি. দীর্ঘ এই প্রবাল প্রাচীর পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান- এর অংশ। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে অবস্থিত গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ শুধু বিশ্বের বিখ্যাত পর্যটন স্থানই নয়, বরং এটি একটি সমৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক নিদর্শন।
জীববৈচিত্র্যে ভরা ছোট-বড় মিলিয়ে ৯০০টি দ্বীপ রয়েছে এ প্রবাল প্রাচীরটিতে। ক্ষুদ্র জলজপ্রাণী থেকে শুরু করে বিশাল তিমি- সবই আছে এখানে। প্রায় ৩০ প্রজাতির তিমি, ডলফিন ও কাছিম এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রয়েছে ৬ প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম, ২১৫ প্রজাতির পাখি এবং ১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ। পৃথিবীর সমগ্র মৎস্যপ্রজাতির প্রায় ১০ ভাগ দ্বীপটিতে দেখা যায়। বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ অন্যতম।
২। রিও ডে জেনিরো
রিও ডে জেনিরো(পর্তুগিজ: Rio de Janeiro অর্থাৎ “জানুয়ারির নদী”) । রিও ডি জেনিরো দক্ষিণ-পূর্ব ব্রাজিলের একটি প্রধান শহর এবং রাজ্যের রাজধানী। শহরটি এককালে ব্রাজিলের (১৭৬৩–১৯৬০) এবং পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের (১৮০৮–১৮২১) রাজধানী ছিল। শহরটি শুধু “রিও” নামেই বেশি পরিচিত।
রিও ডি জেনিরো ব্রাজিলের একটি বৃহৎ সমুদ্রোপকূলীয় শহর। শহরটি যেসব কারণে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত তাদের মধ্যে আছে কোপাকাবানা ও ইপানেমা সৈকতগুলি, কর্কুভাদু পর্বতের উপরে অবস্থিত ৩৮ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট “ত্রাণকর্তা যিশুখ্রিস্ট“ নামক মূর্তি এবং গ্রানাইট শিলাময় “পাঁউ দি আসুকার“ পর্বত (অর্থাৎ “চিনিরুটি” পর্বত) যার শীর্ষে শক্ত তারের উপর দিয়ে চলা একধরনের গাড়িতে করে আরোহণ করা সম্ভব।
এছাড়া প্রতি বছর এখানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কার্নিভাল উৎসব আয়োজন করা হয়, যার গাড়ির বহর ও মিছিল, রঙবেরঙের বেশভূষা, সাম্বা নর্তক-নর্তকীর দল পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত। ইপানেমা সৈকতে ভলিবল, সার্ফিং বা সমুদ্রের ঢেউ-আরোহণ এবং পেদ্রা বোনিতা থেকে প্যারাগ্লাইডিং এখানকার উল্লেখযোগ্য ক্রীড়া। শহরের কাছে তিজুকা জাতীয় উদ্যান অবস্থিত; এটি চিরসবুজ অতিবৃষ্টি অরণ্যে আবৃত, জলপ্রপাতে পরিপূর্ণ একটি পাহাড়ি এলাকা যেখানে রঙবেরঙের বিশাল ঠোঁটের তুকান পাখির নিবাস এবং যেখানে হাইকিং বা পাহাড়ি পদযাত্রা করার সুব্যবস্থা আছে।
মুসেউ দি আর্তি মোদের্না এবং মুসেউ দি আর্তি দু রিউ নামের দুইটি জাদুঘরে আধুনিক শিল্পকলা প্রদর্শিত হয়। রিউতে কিংবদন্তীতুল্য মারাকানা স্টেডিয়াম অবস্থিত, যেখানে ১৯৭০ সালে ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া রিউ ২০১৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।
৩। মাউন্ট এভারেস্ট
মাউন্ট এভারেস্ট পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময়। এটি নেপালে অবস্থিত। চীন ও নেপালের আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষবিন্দু দিয়ে গেছে। বাংলায় যাকে আমরা হিমালয় বলে-ই জানি। এভারেস্টের চূড়ায় প্রথম পা রাখেন নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারী এবং নেপালের তেনজিং নোরগে, ১৯৫৩ সালের ২৯ মে।
মাউন্ট এভারেস্ট হিমালয় পর্বতমালার একটি অংশ, সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে শীর্ষবিন্দুর উচ্চতার হিসেবে এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার (২৯,০২৯ ফুট)। পৃথিবীর এই উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ সব ধরণের পর্বতারোহীদের আকর্ষণ করে। ২০০৮ সালের শেষ পর্যন্ত ২,৭০০ জন পর্বতারোহী সর্বমোট ৪,১০২ বার এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেছেন।
পর্বতারোহীরা নেপালের পর্যটন আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস, কারণ এভারেষ্ট পর্বতশৃঙ্গ আরোহণে ইচ্ছুক প্রত্যেক পর্বতারোহীকে নেপাল সরকারের কাছ থেকে ২৫,০০০ মার্কিন ডলার মূল্যের একটি ব্যয়বহুল পারমিট সংগ্রহ করতে হয়। এতে আরোহণ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ২১০ জন পর্বতারোহী প্রাণ হারিয়েছেন, এর মধ্যে ৮ জন ১৯৯৬ সালে পর্বতের অত্যন্ত উঁচুতে ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারান। বিশেষত ডেথ জোনে আবহাওয়া এতোটাই প্রতিকূল যে বেশিরভাগ সময় হতভাগ্য পর্বতারোহীর মৃতদেহ সেখান থেকে উদ্ধার করা সম্ভবপর হয় না।
৪। অররা মেরুজ্যোতি বা আরোরা অস্ট্রালিস
আরোরা হলো আকাশে একধরণের প্রাকৃতিক আলোর প্রদর্শনী; পৃথিবীর দুই মেরুর আকাশে ঘটে যাওয়া এক নৈসর্গিক প্রাকৃতিক ঘটনা। অনেকে আবার এটিকে স্বর্গীয় আলো বলে থাকে। আমরা হয়তো এই নাম অনেক শুনেছি কিন্তু তার সৃষ্টি হওয়ার রহস্য আমাদের অনেকের মধ্যে জানা নেই। মেরুপ্রভা হলো মেরু অঞ্চলের আকাশে দৃশ্যমান অত্যন্ত মনোরম এবং বাহারি আলোকচ্ছটা যাকে একসময় অতিপ্রাকৃতিক বলে বিবাচনা করা হতো।
বর্তমানে তা নিতান্তই প্রাকৃতিক ঘটনা বলে প্রমাণিত। বায়ুমন্ডলের থার্মোস্ফিয়ারে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সাথে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থেকে আসা চার্জিত কণিকাসমূহের (প্রধা্নত ইলেক্ট্রন, কিছু ক্ষেত্রে প্রোটন) সংঘর্ষের ফলেই অরোরা তৈরী হয়। সংঘর্ষের কারণে পরমাণু বা অণুসমূহ কিছু শক্তি লাভ করে চার্জিত কণিকাসমূহের কাছ থেকে যা অভ্যন্তরীণ শক্তি হিসেবে সঞ্চিত হয়। এসব অভ্যন্তরীণ শক্তি যখন আলোকশক্তি হিসেবে বিকিরিত হয়, তখনই মেরুজ্যোতি দেখা যায়।
প্রধানত উঁচু অক্ষাংশের এলাকাগুলোতে আরোরার দেখা মিলে। কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, গ্রীনল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে আরোরার দেখা মিলে। আরোরাগুলো মাঝে মাঝে আলোর পর্দার মতো দেখায়। তবে এরা গোলাকার অথবা সর্পিল বা বাঁকানোও হতে পারে। বেশিরভাগ আরোরাতে সবুজ রঙ এবং গোলাপী রঙ দেখা যায়। তবে অনেকসময় লাল রঙ বা বেগুনী রঙের হতে পারে। মানব ইতিহাস জুড়ে আরোরার রঙগুলো রহস্যময়। বিভিন্ন মিথোলোজিতে বিভিন্ন কুসংস্কার উল্লেখ করা হয়েছে এটি নিয়ে। তবে বিজ্ঞান বলে আমাদের বায়ুমন্ডলের গ্যাসগুলোই হলো আরোরার বিভিন্ন রঙের কারণ। উদাহরণঃ আরোরার সবুজ রঙের কারণ হলো অক্সিজেন গ্যাস।
৫। প্যারিক্যুটিন আগ্নেয়গিরি
প্যারিক্যুটিন পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে নবীন এ আগ্নেয়গিরির । পৃথিবীর সাত প্রাকৃতিক আশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম। এটি ম্যাক্সিকোতে অবস্থিত। ম্যাক্সিকো শহর থেকে ৩২২ কি. মি. পশ্চিমে এই আগ্নেয়গিরির অবস্থান। প্যারিক্যুটিন আগ্নেয়গিরি ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল।
এই আগ্নেয়গিরির ছাই ও লাভা দুটি শহর পুরোপুরি ধ্বংস করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২ হাজার ৮০০ মিটার। প্যারিক্যুটিন আগ্নেয়গিরি ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল এবং বর্তমানে মৃত অর্থাৎ ভবিষ্যতেও জেগে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ আগ্নেয়গিরির নিক্ষিপ্ত গলিত লাভা, পাথর ও ছাই প্রায় ২৩৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং দুটি শহর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
৬। ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত
ভিক্টোরিয়ার জলপ্রপাত বিশ্বের একটি আশ্চর্যজনক জলপ্রপাত। পৃথিবীর গভীরতম যতগুলো জলপ্রপাত আছে তার মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের সেরা আকর্ষণীয় জায়গা এটি। এই জলপ্রপাতটি জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ের মাঝখানে জাম্বেজি নদীর ওপর অবস্থিত। জলপ্রপাতের নাম রানী ভিক্টোরিয়ার নামে এর নামকরণ করেন অভিযাত্রী ডেভিড লিভিংস্টোন। কিন্তু স্থানীয়রা এটিকে ‘মসি ওয়া তুনইয়া’ নামে ডাকে। যার অর্থ হচ্ছে ‘যে ধোঁয়া বজ্রধ্বনি করে’।
১০৮ মিটার গভীর জলপ্রপাতটি এমন কুয়াশার সৃষ্টি করে যা ২০ কি.মি দূর থেকে দেখা যায়। এটি উচ্চতায় ১০৮.৩ মিটার এবং প্রস্থে এক হাজার ৭০৩ মিটার। প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩৩ হাজার ঘনফুট (৯৩৫ ঘনমিটার) জল পতিত হয়। ইউনেস্কো ১৯৮৯ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে জলপ্রপাতটিকে তালিকাভুক্ত করে। জলপ্রপাতের উভয় অংশকে সংযুক্ত করতে ভিক্টোরিয়া ফলস (জাম্বেজি) সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রেলগাড়ি ও মোটরগাড়ি চলাচল করে। বর্তমানে এটি বহির্বিশ্বের পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ।
৭। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত একটি গিরিখাত। এই গিরিখাতের মধ্য দিয়ে কলোরাডো নদী বয়ে গেছে। গবেষণায় জানা যায় যে, কলোরাডো নদী এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে কমপক্ষে ১৭ মিলিয়ন বছর আগে। এর বেশিরভাগ অংশই গ্রান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক এর ভেতর পরেছে যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথমদিককার জাতীয় উদ্যান।
এই গিরিখাত দৈর্ঘ্যে ২৭৭ মাইল, প্রস্থে সর্বোচ্চ ১৮ মাইল এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ১ মাইলেরও অধিক। এরপর ৭০ মিলিয়ন বছর আগে কলোরাডো নদী বরফ গলা পানি সহ মোগোলান হাইল্যান্ডস এর উপর প্রবাহিত হতে শুরু করে। এর ফলে সেখানে শুরু হয় ভূমিক্ষয়। পুরোনো সেই নদীর অস্তিত্ব এখনও বোঝা যায়। যদিও নদীতে এখন আর কোন পানির অস্তিত্ব নেই। গ্রান্ড ক্যানিয়নে কলোরাডো নদীর পাহাড়ের ঢাল থেকে নেমে আসার ধারাটি এখনও সম্পুর্নরূপেই বিদ্যমান।
এ ভাবেই যদি চলতে থাকলে আগামী ২০ লাখ বছরে গ্রান্ড ক্যানিয়নের গভীরতা আরো অনেক গুন বৃদ্ধি পাবে। প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এই গিরিখাতের সংরক্ষণে একটি বড় ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রায়ই এখানে শিকার এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসতেন। প্রাকৃতিক যে সব বিস্ময় মানুষকে যুগে যুগে মুগ্ধ করেছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তাদের মধ্যে অনন্য।
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন