ভুল থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তবে মন্দ কি? আর সেই “দারুণ কিছু” যদি হয় পৃথিবী কাঁপিয়ে দেওয়া সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, তবে তো কথাই নেই! মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিজ্ঞানের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলো আসলে আবিষ্কার করার কথা কল্পনাই করেননি আবিষ্কারক! যা হওয়ার তা হয়েছে নিতান্তই দুর্ঘটনা বা ভুলবশত। এমন আরো কিছু আবিষ্কার আর তার পেছনের মজার সব ঘটনা নিয়ে এই লেখা।
মাইক্রোওয়েভ ওভেন
গবেষণাগারে খাওয়া–দাওয়া করা নিশ্চয়ই খুব কাজের কথা নয়! কিন্তু এই কাজটি করতে গিয়েই পার্সি স্পেনসার নামের এক আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার যুগান্তকারী এক আবিষ্কার করে ফেলেন!
তিনি ম্যাগনেট্রন নামে একটি ভ্যাকুয়াম টিউব নিয়ে কাজ করছিলেন, যেটি থেকে মাইক্রোওয়েভ নির্গত হয়। টিউবের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছিলেন তিনি, হঠাৎ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন বিচিত্র একটি ব্যাপার ঘটেছে– তার প্যান্টের পকেটে রাখা চকলেটের বার গলতে শুরু করেছে!
বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী স্পেনসার তখনই বুঝতে পারেন একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার ততক্ষণে তিনি করে ফেলেছেন।
বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর ১৯৪৫ সালে তিনি প্রথম মাইক্রোওয়েভ ওভেন তৈরি করেন, আকারে সেটি ঢাউস একটি জিনিস ছিল। ১৯৬৭ সাল থেকে মাইক্রোওয়েভ ওভেন যুক্তরাষ্ট্রের ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। এখন তো পৃথিবীজুড়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেনের জনপ্রিয়তার জুড়ি মেলে।
পেনিসিলিন
পেনিসিলিন চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি অসামান্য আবিষ্কার। এটি পৃথিবীতে আবিষ্কৃত প্রথম এ্যান্টিবায়োটিক যা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, যিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং জীবাণুতত্ত্ববিদ।
১৯২১ সালের ঘটনা, তখন ইংল্যান্ডের সেন্ট মেরিজ মেডিকেল স্কুলের ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। কয়েকদিন ধরে তিনি ঠাণ্ডায় ভুগছিলেন। জীবাণু কালচার নিয়ে ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় হঠাৎ তীব্র হাঁচি এলো। ফ্লেমিং নিজেকে সামলাতে পারলেন না, সেটটা সরানোর আগেই হাঁচির দমকে নাক থেকে কিছুটা সর্দি সেটের উপর পড়ে গেলো!
পুরো জিনিসটা নষ্ট হয়ে গেল দেখে সেটটা সরিয়ে রেখে নতুন আরেকটা সেট নিয়ে কাজ শুরু করলেন। পরদিন ল্যাবরেটরিতে ঢুকে সরিয়ে রাখা সেই সেটটার দিকে নজর পড়ল তার, ভাবলেন সেটটা ধুয়ে কাজ করবেন। কিন্তু সেটটি হাতে তুলেই চমকে উঠলেন ফ্লেমিং। অবাক ব্যাপার, গতকালের জীবাণুগুলো আর নেই! তিনি দেহ থেকে বের হওয়া এই প্রতিষেধকটির নাম দিলেন লাইসোজাইম।
অনেক বছর পরের কথা, ১৯২৮ সালে ফ্লেমিং স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করছিলেন লন্ডনের এক ল্যাবরেটরিতে। মাঝে গবেষণা স্থগিত রেখে তিনি বেড়াতে যান স্কটল্যান্ডে। যাবার সময় তিনি স্টেফাইলোকক্কাসটি একটি কাঁচের পাত্রে রেখে যান এবং একটি ভুল করেন- গবেষণাগারের জানালা খুলে রেখে যান! এই ভুলের বদৌলতেই ফ্লেমিং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্ময়কর জিনিসটি আবিষ্কার করেন।
দু’সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে গবেষণাগারে ফিরে তিনি আবিষ্কার করেন, কোন ফাঁকে ঝড়ো বাতাসের দমকে খোলা জানালা দিয়ে ল্যাবরেটরির বাগান থেকে কিছু ঘাস পাতা উড়ে এসে পড়েছে জীবাণু ভর্তি প্লেটের উপর। তিনি প্লেটগুলোতে দেখলেন জীবাণুর কালচারের মধ্যে স্পষ্ট পরিবর্তন।
ফ্লেমিং বুঝলেন এই আগাছাগুলোর মধ্যে এমন কিছু আছে যার জন্য পরিবর্তন ঘটেছে, পরীক্ষা করে দেখা গেলো আগাছাগুলোর উপর একরকম ছত্রাক জন্ম নিয়েছে। সেই ছত্রাকগুলো বেছে বেছে জীবাণুর উপর দিতেই জীবাণুগুলো ধ্বংস হয়ে গেল! তিনি বুঝতে পারলেন, তার এতোদিনের গবেষণা অবশেষে সার্থক হয়েছে! ছত্রাকগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ছিল পেনিসিলিয়াম নোটেটাম, তাই তিনি এর নাম দিলেন পেনিসিলিন।
১৯৪৫ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার এবং মানবকল্যাণে এর অসামান্য অবদানের জন্য আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। পুরষ্কার পেয়ে ফ্লেমিং কৌতুক করে বলেন, ‘এ পুরষ্কারটি ঈশ্বরের পাওয়া উচিত, কারণ তিনিই সবকিছুর আকস্মিক যোগাযোগ ঘটিয়েছেন।’
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এই পেনিসিলিন। জীবনের ছোট্ট একটি ভুলের পুরষ্কার স্বরুপ আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ইতিহাসের পাতায় চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন।
৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি অনলাইন ব্যাচ ২০২৪
ফুল সিলেবাস কোর্সে যা যা থাকছে:
এক্স–রে
এক্সরে বা রঞ্জন রশ্মি হচ্ছে একটি তড়িৎ চৌম্বক বিকিরণ। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য টেন ইনভার্স টেন মিটার যা সাধারণ আলোর চেয়েও অনেক কম। তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম থাকার কারণে এটি যে কোনো পদার্থকে খুব সহজেই ভেদ করতে পারে।
“ক্যাথোড রে” আবিষ্কার হয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু গবেষকরা তখনও জানতেন না এটি ব্যবহার করে মানবদেহের কঙ্কালের ছবি তোলা সম্ভব। ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম রঞ্জন একটি কালো কাগজে ঢাকা গ্লাস টিউবে ক্যাথোড রশ্মি চালিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল কাঁচ থেকে ক্যাথোড রে বের হয় কিনা সেটি পরীক্ষা করা।
কিন্তু এমন সময় একটি মজার ঘটনা ঘটলো, রঞ্জন লক্ষ্য করলেন, তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার কয়েক ফুট দূরে একরকম আলোক রশ্মি দেখা যাচ্ছে! তিনি ভাবলেন কার্ডবোর্ড কোথাও ফেটে গিয়ে হয়ত আলো বের হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেলো- কার্ডবোর্ড ফেটে নয় বরং কার্ডবোর্ড ভেদ করে রশ্মি বের হচ্ছে!
ঘটনা দেখে রঞ্জনের মাথায় বিচিত্র একটি আইডিয়া খেলে গেলো- যে রশ্মি কার্ডবোর্ড ভেদ করতে পারছে তা মানবদেহ কেন ভেদ করতে পারবে না? যেই ভাবা সেই কাজ, তিনি তার স্ত্রীর হাত সামনে রেখে পরীক্ষা চালালেন এবং ইতিহাস বদলে দেওয়া একটি ঘটনা ঘটলো- প্রথমবারের মতো কাটাছেঁড়া না করেই মানবদেহের কঙ্কালের ফটোগ্রাফিক ইমেজ তৈরি সম্ভব হলো! রঞ্জনের স্ত্রী নিজের কঙ্কালের ছবি দেখে আঁতকে উঠে বলেন, “আমি যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে!”
আরও পড়ুন: পরীক্ষাটা কে আবিষ্কার করেছেন!!!
অদৃশ্য এই রশ্মির বৈশিষ্ট্য অজানা থাকায় রঞ্জন এর নাম দেন এক্স-রে। অবশ্য একে তার নাম অনুসারে অনেকে রঞ্জন রশ্মি নামেও ডাকে।
ক্লোরোফর্ম
সেকালে অস্ত্রোপচার করা হতো কোনরকম চেতনানাশক ছাড়া, ফলে রোগীকে অমানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো অস্ত্রোপচার টেবিলে। এ অবস্থার নিরসন ঘটে ক্লোরোফর্ম আবিষ্কারের পরে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ক্লোরোফর্ম আবিষ্কারের ঘটনাটি দুর্ঘটনার চেয়ে কম কিছু নয়!
স্যার জেমস ইয়ং সিম্পসন বহুদিন ধরেই চেতনানাশক নিয়ে গবেষণা করছিলেন। একদিন এডিনবার্গে নিজ বাড়িতে আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে আলাপচারিতার ফাঁকে তার মনে হলো নিজের আবিষ্কার পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়?
যেই ভাবা সেই কাজ, একটি শিশিতে করে ক্লোরোফর্ম অতিথিবৃন্দের সামনে আনলেন। তারপর আর কারো কিছু মনে নেই! হুঁশ ফিরলো পরদিন সকালে, এদিকে অতিথিরা একেকজন বেহুঁশ হয়ে এদিক ওদিক পড়ে আছেন। শুরুতে তিনি ভয়ই পেয়ে গেলেন। পরে সবার জ্ঞান ফিরলে আশ্বস্ত হন।
যদিও পরবর্তীতে এমন বিপজ্জনক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলেন তিনি, কারণ বর্ণহীন এই জৈন যৌগটি খোলা জায়গায় রেখে দিলে উড়ে যেতে থাকে। বাতাসে ক্লোরোফর্মের পরিমাণ খুব বেশি হয়ে গেলে তা মারাত্মক ক্ষতিকর। যেহেতু এটি সরাসরি স্নায়ুর ওপর ক্রিয়া করে, তাই বেশি পরিমাণে শরীরে প্রবেশ করলে মাথাব্যথা থেকে শুরু করে কিডনি ও লিভারের স্থায়ী সমস্যা তৈরি হতে পারে।
বড় ধরনের অপারেশনে ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা হয়ে থাকে
যাই হোক, সিম্পসন অবশেষে ১৯৪৭ সালে এই আবিষ্কারের কথা জানান সবাইকে, এবং মাত্র তিন বছরের মাথায় শুরু হয়ে যায় রোগীদের অপারেশনের বেলায় অজ্ঞান করার কাজে আন্তর্জাতিকভাবে ক্লোরোফর্মের ব্যবহার।
ক্লোরোফর্ম সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় রাসায়নিক ল্যাবরেটরি ও বাণিজ্যিকভাবে প্লাস্টিক তৈরিতে। এর পরই ব্যবহৃত হয় মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর শরীরের কিছু অংশ অবশ করতে বা সাময়িকভাবে অজ্ঞান করতে। রোগীদের দেহের সূক্ষ্ম কাটাকাটি থেকে শুরু করে বড় ধরনের অপারেশনে ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ডায়নামাইট
নোবেল পুরষ্কারের প্রবক্তা হিসেবে আলফ্রেড নোবেল চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন ইতিহাসে, তিনি ছিলেন একজন সুইডিশ রসায়নবিদ এবং ইঞ্জিনিয়ার। রাসায়নিক বিভিন্ন বিপদজনক তরল পদার্থ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নোবেল এবং তার ল্যাবরেটরির মানুষজন বেশ কয়েকবার ভয়াবহ সব দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনা খুব মারাত্মক ছিল, ১৮৬৪ সালে সুইডেনের স্টকহোমে সেই বিস্ফোরণে আলফ্রেড নোবেলের ছোটভাই সহ আরো কয়েকজন মারা যায়।
ভাইয়ের মৃত্যুতে নোবেল ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েন। এই ঘটনার পর আলফ্রেড নোবেল নিরাপদভাবে বিস্ফোরণ ঘটানোর উপকরণ আবিষ্কারের জন্য উঠে-পড়ে লাগেন।
মজার ব্যাপার হলো মারাত্মক বিস্ফোরক নাইট্রোগ্লিসারিনকে সামলানোর উপায় নোবেল খুঁজে পান আরেকটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে! একবার নাইট্রোগ্লিসারিন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়ার সময় নোবেল দেখেন একটি পাত্র ছিদ্র হয়ে খুলে গেছে। দেখা গেল পাত্র মোড়ানো ছিল যে জিনিসটি দিয়ে সেটি ভয়াবহ বিস্ফোরক নাইটড়োগ্লিসারিনকে খুব ভালোভাবে শোষণ করেছে। কিয়েসেলগার নামে এক ধরনের পাললিক শিলার মিশ্রণ দিয়ে পাত্রগুলো মোড়ানো ছিল।
Microsoft Office 3 in 1 Bundle
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
নাইট্রোগ্লিসারিন যেহেতু তরল অবস্থায় খুব বিপদজনক, তাই নোবেল সিদ্ধান্ত নেন এই কিয়েসেলগারকে তিনি বিস্ফোরকের স্ট্যাবিলাইজার হিসাবে ব্যবহার করবেন। ১৮৬৭ সালে নোবেল তার আবিষ্কৃত নিরাপদ কিন্তু মারাত্মক শক্তিশালী এই বিস্ফোরকটি ‘ডিনামাইট’ নামে পেটেন্ট করান।
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: https://10minuteschool.com/admission
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- English Grammar Crash Course by Sakib Bin Rashid
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
আপনার কমেন্ট লিখুন