সাল ১৯৭১! বাঙালির জীবনের শত সহস্র আবেগ যেন এই বছরটিকে ঘিরে। হবে না-ই বা কেন? নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তেইশ বছরের শোষণ ও বঞ্চনার ইতি ঘটিয়ে পৃথিবীর বুকে লাল সবুজের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর গাঁথাটা অত্যন্ত গৌরবের। এই গৌরব অর্জনের সৌভাগ্য কী সবার হয়! আর এই গৌরব অর্জন ও বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের নেপথ্য নায়ক, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটাও প্রত্যেক বাংলাদেশির মনে গেঁথে আছে চিরস্থায়ীভাবে। আজ স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পরও একজন বঙ্গবন্ধু-ই প্রত্যেক তরুণ-যুবকের অনুপ্রেরণার উৎস, যে কোনো অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মূর্ত প্রতীক! কিন্তু কতটুকু জানি আমরা এই মহান নায়ককে? ফিদেল কাস্ত্রো যাকে হিমালয়ের সাথে তুলনা করেছিলেন, যার ৬ দফা দাবিকে বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বলা হয়, যাকে বলা হয় ‘রাজনীতির কবি’, যার আদর্শকে কেন্দ্র করে আমাদের সত্ত্বা বিবর্তিত, তাঁর জীবনী সম্পর্কে জানাটা শুধু প্রয়োজনই নয় বরং অত্যাবশ্যক।
এজন্যেই আজকে আলোচনা করা হবে সেই ৫টি বই নিয়ে যেগুলো পড়লে আমরা আরো বিস্তারিতভাবে জানতে পারব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি সম্পর্কে-
১। অসমাপ্ত আত্মজীবনী
লেখক: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রকাশনী: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অনেকটা আকস্মিকভাবেই পিতার চারটি খাতা হাতে পান। অতি পুরোনো, জীর্ণপ্রায় পাতাগুলোর লেখা পড়ে জানা যায় এটি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালীন অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন।
“বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।” বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি, যা লেখা যায়। আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”
অসমাপ্ত আত্মজীবনী (Image Source: Prothom Alo)
সাধারণ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থগুলোতে নিজের মহিমা প্রচারের যে প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় এই গ্রন্থটি যে তা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ধারায় রচিত, বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর সহধর্মিণীর এই কথোপকথনের মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায়। নিজের বংশ পরিচয়, শৈশব, শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কথা বিবৃত হয়েছে এই বইয়ে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীজুড়েই আছে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। নিজের জীবনদর্শনের এমন অনেক প্রসঙ্গ এই বইতে আছে যা ব্যক্তি শেখ মুজিব সম্পর্কে পাঠকদের একটি সঠিক ধারণা দিয়ে থাকে।
কোর্সটিতে যা যা পাচ্ছেন:
বিসিএস প্রিলি লাইভ কোর্স
সেই সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশ বিভাগের পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের বর্ণনা বইটিকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে জাতির জনকের সামগ্রিক জীবন সম্পর্কে জানতে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রামাণ্য দলিল এটি। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে গ্রন্থটি ২০১২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
২। কারাগারের রোজনামচা
লেখক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রকাশনী: বাংলা একাডেমি
ছয় দফা আন্দোলন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতারের পর ১৯৬৬ সালের ২ জুন থেকে ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুর্মিটোলা সেনানিবাসে অফিসার মেসে বঙ্গবন্ধুর কারাগারে থাকাকালীন দিনগুলোর বিবরণ নিয়েই ‘কারাগারের রোজনামচা’ লেখা হয়েছে। এটি বঙ্গবন্ধুর লেখা দ্বিতীয় রচনা। শুরুতে ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা-
“ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের সোপানগুলো যে কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এগোতে হয়েছে, তার কিছুটা এই বই থেকে পাওয়া যাবে। বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে এ আত্মবিশ্বাস বারবার তাঁর (বঙ্গবন্ধু) লেখায় ফুটে উঠেছে। এত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছেন কি না আমি জানি না।”
বইটিতে জেলজীবনের খুঁটিনাটি নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে। সমকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা এবং বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবনের অনেক ঘটনা উপস্থাপিত হয়েছে বইটিতে।
সরকারি চাকরি প্রস্তুতি বেসিক কোর্স
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
জেলখানার অভ্যন্তরের বিষয় সাধারণ মানুষের জানার সুযোগ থাকে না। বঙ্গবন্ধু বইটি শুরু করেছেন এভাবে-
“জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই তারা জানে না জেল কী জিনিস। বাইরে থেকে মানুষের যে ধারণা জেল সম্বন্ধে ভিতরে তার একদম উল্টা। জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে।”
আরো পড়ুন: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম: বিদ্রোহী বাঙ্গালির প্রতিচ্ছবি
তিনি দুঃখী মানুষের জীবনও উপলব্ধি করেছেন জেলখানায় বসে। পুরো বইয়ের অনেক জায়গায় এমন অনেক মন্তব্য আছে যা রাজনীতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মানবিক দর্শন বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ করে।
বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তি যা প্রকাশ করে দেশের মানুষের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা। Image Source: AZ Quotes
তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ দুটি গ্রন্থেই বিভিন্ন সময়ে তাঁর সহধর্মিনীর প্রতি গভীর ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস ও পরম নির্ভরতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি অবস্থায় থেকেও তিনি প্রকৃতির যে অসাধারণ রূপ অঙ্কন করেছেন তা তাঁর সৃজনশীল মননের পরিচয় দেয়।
৩। আমার দেখা নয়াচীন
লেখক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রকাশনী: বাংলা একাডেমি
বঙ্গবন্ধুর লেখা তৃতীয় বই এটি। নাম শুনেই ধারণা করা যায় বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে। বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের ইতিবৃত্ত নিয়ে রচিত হয়েছে বইটি।
১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে চীনের পিকিং-এ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তদানীন্তন পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলা থেকে শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন। পূর্ববাংলা থেকে তাঁর ভ্রমণ-সঙ্গী ছিলেন পূর্ববাংলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ও ইউসুফ হাসান। এ সফরে চীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও সে তুং এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়। এসময় তিনি চীনের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অবস্থা গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন।
বঙ্গবন্ধু আরও একবার চীনে গিয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে। সে সময় তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার শ্রমমন্ত্রী। পরের বারের চীন ভ্রমণের নানা ছবিও উঠে এসেছে গ্রন্থে।
তবে গ্রন্থটিকে শুধু ভ্রমণকাহিনী বললে ভুল হবে, চীনের সমাজ-দর্শন, কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকদর্শন ও মূল্যায়নমূলক পর্যালোচনা বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। একজন তরুণ রাজনীতিকের উপলব্ধিতে এসেছে দারুণ সব অভিজ্ঞতার বয়ান এবং নয়া চীন রাষ্ট্রের সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের গল্প। তরুণ বয়সেই বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতায় রূপান্তরিত হচ্ছিলেন; এ গ্রন্থ তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি বইটি প্রকাশ করে।
৪। শেখ মুজিব আমার পিতা
লেখক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রকাশনী: আগামী প্রকাশনী
আমাদের বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। কিন্তু কন্যার দৃষ্টিতে কেমন ছিলেন তিনি?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রচিত এ গ্রন্থটি মূলত স্মৃতিচারণমূলক রচনা। বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের অনেক অজানা তথ্য স্থান পেয়েছে বইটিতে। স্বজন হারানোর মর্মস্পর্শী ব্যথা থেকে শুরু করে জননেত্রীর নিজ সংগ্রামের ইতিহাসও স্থান পেয়েছে গ্রন্থটিতে।
বইটি প্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে কলকাতা বইমেলায়। কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা ‘সাহিত্যম প্রকাশনালয়’ মেলায় বইটি প্রকাশ করে। আগামী প্রকাশনী থেকে শেখ হাসিনার এই বইয়ের বাংলাদেশ সংস্করণ প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে বইমেলায়।
৫। বঙ্গবন্ধু অভিধান
লেখক: শেখ সাদী
প্রকাশনী: কথাপ্রকাশ
অভিধান শব্দটি শুনলেই মাথায় আসে এমন একটি বইয়ের কথা যাতে একটি নির্দিষ্ট ভাষার শব্দের অর্থ, উচ্চারণ, ব্যবহার ইত্যাদি বর্ণানুক্রমে সাজানো থাকে। কিন্তু কোনো মানুষকে নিয়ে কি অভিধান রচনা করা সম্ভব?
সম্ভব। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সম্পূর্ণ অভিধান রচনা করেছেন শেখ সাদী। পেশায় তিনি টেলিভিশন সাংবাদিক। তবে বঙ্গবন্ধুর জীবনী লিখতে গিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা নিয়েছিলেন। শেখ সাদীর প্রায় পঁচিশ বছরের সাধনার ফসল ‘বঙ্গবন্ধু অভিধান’ বইটি। এক মলাটে বঙ্গবন্ধুর জীবনের আদ্যোপান্ত পাওয়া যাবে বইটিতে। শুধু তাই নয়, বাংলার রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ এবং তার সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পৃক্ততাও ফুটে উঠেছে বেশ সাবলীলভাবে।
জীবনীসাহিত্য ও বাংলার ইতিহাসে বইটি যে এক অমূল্য সংযোজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এর মধ্যে কয়টি বই আপনি পড়েছেন? কয়টি বই সম্পর্কে আজই প্রথম জানতে পারলেন?
তথ্যসূত্র:
- বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো – Prothom Alo
- ‘কারাগারের রোজনামচা’: বাঙালির জাগরণের দলিল – Channel I
- বঙ্গবন্ধুর দেখা নয়াচীন – Prothom Alo
- আমার দেখা নয়াচীন – শেখ মুজিবুর রহমান – Liberation War Bangladesh
- তিন ভাষায় প্রকাশ হবে প্রধানমন্ত্রীর বই – Bangla Tribune
- বঙ্গবন্ধু অভিধান লেখার অভিজ্ঞতা – দৈনিক জাগরণ
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- English Grammar Crash Course by Sakib Bin Rashid
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারেন এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন