শুরুটা করছি ডেভিড বার্কুইটজকে দিয়ে। যে ‘সন অফ স্যাম’ নামে আরও বেশি পরিচিত। এই অদ্ভুত নামকরনের পেছনের গল্পটা কিন্তু বেশ রহস্যময়। আগে বলা যাক, সন অফ স্যাম নামে তিনি পরিচিত কেন? ইনি আসলে একজন আমেরিকান সিরিয়াল কিলার, ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে যার গুলিতে নিহত হন আটজন নারী। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, তার খুন করার কারণ সম্পর্কে, তখন উঠে আসে এক অদ্ভুত গল্প।
ডেভিড বলেন, তিনি আসলে এক ডেমনের হুকুমে খুনগুলো করেছেন এবং সেই ডেমন আসলে তার প্রতিবেশী ‘স্যাম’। তিনি নিজেকে ‘সন অফ স্যাম’ বলে দাবী করেন। তিনি এও বলেন, ডেমনরা সবসময় তাকে নজরে রাখছে, তাই তিনি না চাইলেও খুন করতে বাধ্য। ডেমনরা তার কানে ফিসফিসিয়ে বিভিন্ন ধরনের হুকুম করে, যা তিনি চাইলেও অগ্রাহ্য করতে পারেন না। এমনকি তিনি কাকে হত্যা করবেন তাও ডেমনরাই তাকে বলে দেয়।
এরকম অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র ডেভিডের হয়, এমন না। আমরা আমাদের চারপাশে দেখলে এরকম অনেক মানুষকে পাব যারা এমন কিছু দেখতে বা শুনতে পায়, যা অন্য সবাই পায় না।
তারা এটাকে ব্যাখ্যা করে ‘ভুত’ দেখা হিসেবে। কিন্তু পারতপক্ষে এটি একটি জটিল মানসিক রোগ, যা সিজোফ্রেনিয়া নামে পরিচিত। যাকে সাইকোলজির ভাষায় মনের ক্যান্সারও বলা চলে!
শুরুর কথা
১৯১১ সালে ইউগেন ব্লেয়ার প্রথম সিজোফ্রেনিয়া শব্দটি ব্যবহার করেন। তারও আগে ১৮৮৭ সালে জার্মান মনোবিজ্ঞানী এমিল ক্রেপলিন এই রোগের সন্ধান পান এবং এটিকে আচরণের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন।
জানোই তো, মানসিক রোগ মনের সাথে সম্পর্কিত। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এসব রোগ মানুষের মস্তিষ্কে জন্ম থেকেই মিশে আছে!
সিজোফ্রেনিয়া কী?
এতক্ষণে এতটুকু তো বুঝে গেছ যে সিজোফ্রেনিয়া হল এক ধরনের জটিল মানসিক রোগ। এই রোগটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তা নিয়ে আরও পরে আলোচনা করছি। সিজোফ্রেনিয়া কী বুঝতে হলে, তোমাকে কিছু জিনিস কল্পনা করতে হবে।
ভাবো, তুমি কিছু শব্দ শুনতে পাচ্ছ, যেন তোমাকে কেউ কিছু কথা বলতে চাচ্ছে। এই শব্দগুলো তুমি ছাড়া কেউ শুনতে পাবে না।
একসময় মনে হতে থাকবে, তোমার চামড়ার নিচ দিয়ে কিছু হাঁটছে। এমনকি তুমি সন্দেহ করতে থাকবে, কেউ একজন তোমার উপর গুপ্তচরগিরি করছে।
হয়ত তুমি এও ভাববে যে তোমার উপর ভুতের আছর হয়েছে। তুমি আসলে প্রেতাত্মাদের আওয়াজ শুনছো!
এরই সাথে তোমার হ্যালুসিনেশনও হতে পারে। তুমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছ যা আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না! যদি তুমি এমন অবস্থায় থাক, তাহলে বলা যাবে, তুমি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত!
আরো পড়ুন: জেনে নাও অদ্ভুত এ পৃথিবীর ২০টি চমক!
সিজোফ্রেনিয়ার বৈশিষ্ট্য
বুঝতেই পারছো সিজোফ্রেনিয়া জটিল এবং বিস্তৃত রোগ, এর বৈশিষ্ট্যও তাই অনেক! আসলে এর বৈশিষ্ট্য তিন ধরনের হয়। নেগেটিভ, পজেটিভ এবং কগনিটিভ।
নেগেটিভ বৈশিষ্ট্য হল ‘ফ্লাট ইফেক্ট’। সমাজ জীবনে খাপ খাওয়াতে না পারা, একাকীত্বের জীবন বেছে নেয়া। নিজের আবেগ প্রকাশ করতে না পারা। এসব!
পজেটিভ বেশিষ্ট্য গুলো বেশ ভয়ঙ্কর। যেমন, একটি হল ‘ডিল্যুশন’। এর মানে হল, রোগী কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস রাখে। যেমন ধর, রোগী এটা ভাবতে পারে যে মঙ্গল গ্রহ থেকে তার সাথে কথা বলা হচ্ছে। বা, কোনো এজেন্ট তার মাথায় ট্রান্সমিটার বসিয়ে দিয়েছে। প্রেতাত্মার সাথে কথা বলছে ভাবাও কিন্তু এক ধরনের ডিল্যুশন।
আরও একটি পজেটিভ বৈশিষ্ট্য হল হ্যালুসিনেশন হওয়া। মানে, যা নেই তা দেখা। মস্তিষ্ক নিজের মতন একটি দৃশ্য তৈরি করে ফেলে, যেটা রোগীর বাস্তব মনে হয়। যেমন ধর, ভুত দেখা!
কোর্সটি করে যা শিখবেন:
২৪ ঘণ্টায় কোরআন শিখি
কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় মনোযোগ দিতে না পারা, কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহন না করতে পারা, কিছু মনে না থাকা কগনিটিভ বৈশিষ্ট্য।
এ ধরনের রোগীরা ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে পছন্দ করে। অনেকে ঘরে ফেরে না। গ্রামাঞ্চলে এই ঘটনাটিকেও প্যারানরমাল একটিভিটি ধরা হয়। আর এই ব্যাপারে দায়ী করা হয় ‘নিশি’ নামের প্রেতকে।
সিজোফ্রেনিকদের মধ্যে আরও একটা বিষয় বেশ দেখা যায়। তারা খুবই সৃজনশীল হয়ে থাকে। বিশেষত সঙ্গীত এবং ছবি আঁকায় তারা বিশেষ পারদর্শী হয়।
সিজোফ্রেনিয়া কেন হয়?
সিজোফ্রেনিয়া হওয়ার বায়োলজিকাল কারণ এবং পরিবেশগত কারণ আছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বংশানুক্রমে রোগটি ছড়ায়। বাবা এবং মার মধ্যে শুধু একজনের রোগটি থাকলে ১৭% সম্ভাবনা থাকে সন্তানেরও এ রোগ হওয়ার। আর বাবা মা দুজনের থাকলে সম্ভাবনাটি দাঁড়ায় ৪৫% এ গিয়ে!
গবেষণায় এও দেখা গেছে, আসলে রোগটি সৃষ্টির জন্য একটি জিন নয়, আটটি জিন দায়ী। এই আটটি জিনের বিশৃঙ্খলতার কারণে সিজোফ্রেনিয়া হয়। সিজোফ্রেনিয়া হল একধরনের রাসায়নিক বিশৃঙ্খলতার ফল, যা ডোপামিন, গ্লুটামিন এবং নিউরোট্রান্সমিটারে হয়।
এতো গেলো বায়োলজিকাল কারণ। পরিবেশগত কারণটাই বেশি মুখ্য এখানে। আসলে সিজোফ্রেনিয়ার বীজ শৈশবে লাগানো হয়। কোনো বিশেষ ঘটনা মনের ভেতর তীব্র ছাপ ফেলে এমন কিছু তৈরি করে। যে পরিবেশে একটা শিশু বড় হয়, সেই পরিবেশের উপর নির্ভর করে শিশুটি সিজোফ্রেনিক হবে কিনা।
যেমন, সন অফ স্যামের সিজোফ্রেনিক হবার পেছনের রহস্যটা বলা যাক। ডেভিড আসলে দত্তক সন্তান ছিলেন। প্রি-স্কুলে থাকতে তাকে একদিন তার সহপাঠী বললো, ‘তোমাকে তো তোমার আসল মা বাবা ফেলে দিয়েছেন।’
এই কথাটি ডেভিডের মনে গেঁথে যায়। পরবর্তীতে স্যাম নামের সেই প্রতিবেশীর কাছ থেকে বেশ ক’বার ডেভিড নির্যাতিত হন। এবং এ দুইয়ে মিলে তার মস্তিষ্কে দানা বাঁধে এই রোগটি।
তিনি স্যামকে কল্পনা করেন ডেভিল রূপে এবং সেই ডেভিল প্রতিনিয়ত তার কানে ফিসফিস করতে থাকে। এরপর তিনি একে একে খুন করতে থাকেন কালো কোঁকড়া চুলের তরুণীদের।
এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, সিজোফ্রেনিয়া আসলে একটা বিশাল ডালপালা সহ গাছ, যার বীজ বপন করা হয় শৈশবে!
সিজোফ্রেনিয়া কতটুকু মারাত্মক
সিজোফ্রেনিয়াকে বলা হয় সাইকোলজির ক্যান্সার। ১৫% ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়া ভাল হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগটি সারানো যায় না। এমন অনেক দেখা যায়, রোগী গায়েবী কন্ঠস্বর শুনতে চায় না বলে নিজের কান কেটে ফেলে। এমন অনেক রোগী আছে যারা নিজের চারপাশের মানুষদের এতটাই সন্দেহ করে যে, কাছে কেউ গেলেই ধারালো অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসে। প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস ছেড়ে তাই এসব উপসর্গ দেখা দেয়া প্রত্যেকটি মানুষের উচিত সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া।
প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস ও ঝাড়ফুঁক
গ্রামাঞ্চলের মানুষ দের এখন পর্যন্ত ধারনা, ভুত প্রেতের আক্রমনে এরকম বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সিজোফ্রেনিয়ার রোগীকে শেকল দিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে বা ওঝা ডেকে বিভিন্ন রিচুয়াল করা হচ্ছে। এসব করলে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হবার সম্ভাবনা থাকে। এবং এ ধরনের কাজ রোগীর জন্য অত্যাচারও বটে!
বিখ্যাত সিজোফ্রেনিক
বলছি আমেরিকান ম্যাথমেটিশিয়ান জন ন্যাশের কথা। যিনি কিনা একজন সিজোফ্রেনিক ছিলেন। অর্থনীতিতে অবদানের জন্য যৌথভাবে নোবেল পান ১৯৯৪ সালে। তাঁর বায়োগ্রাফি নিয়ে সিনেমা বানানো হয় যা ২০০১ এ একাডেমী পুরষ্কার পায়। সিনেমাটির নাম, ‘A Beautiful Mind‘।
শুধু জন ন্যাশ নন, এমন অনেক সাহিত্যিক, সংগীত শিল্পী, অভিনেতা আছেন যারা সিজোফ্রেনিক ছিলেন। সিজোফ্রেনিয়া জীবনের জন্য কোনো বাঁধা না। আব্রাহাম লিংকনের স্ত্রী মেরি লিংকনও সিজোফ্রেনিক ছিলেন। এলবার্ট আইন্সটাইনের ছেলে এডুয়ার্ড আইনস্টাইন কিংবা জ্যাজ মিউজিশিয়ান টম হ্যারেলের মত তারকারাও বয়ে বেড়িয়েছেন এই সিজোফ্রেনিয়া।
এক জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকায় প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ জীবনে একবার হলেও সিজোফ্রনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে সেই সংখ্যা টি হল সতের লাখ। অন্ধবিশ্বাস থেকে উঠতে পারছি না বলেই আমাদের দেশে এর হার এত বেশি। এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিশ্বে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা সতেরো হাজার।
প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস থেকে বের হয়ে আমরা বরং বলি, এটি আসলে ভুতে ধরা নয়, সিজোফ্রেনিয়া!
একটু আগেই তো জানলে, ‘A Beautiful Mind’ নামের সিনেমার উপজীব্য হল একজন সিজোফ্রেনিক। সিজোফ্রেনিয়াকে উপজীব্য করে হুমায়ুন আহমেদ একটি উপন্যাস ও লিখেছিলেন। যার নাম হল, ‘আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি’। সময় করে পড়ে ফেলবে কিন্তু!
আমাদের কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে ক্লিক করুন:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft Excel Premium Course
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
১০ মিনিট স্কুলের ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে ভিজিট করুন: www.10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন