মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা মজার তথ্য দেই, নয়তো পরে ভুলে যেতে পারি। টাইম ট্রাভেল নিয়ে তো আমাদের অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে, তাই না? মনে মনে ইচ্ছা জাগে “ইশ, টাইম ট্রাভেল করে আমি যদি আমার ছোটবেলার সেই মজার সময়গুলোতে ফিরে যেতে পারতাম, কি দারুণ একটা ব্যাপার-স্যাপারই হতো, তাই না?” আচ্ছা তোমরা কি জানো আমরা প্রতিনিয়তই টাইম ট্রাভেল করছি? কি? শুনে তাজ্জব হয়ে গেলে নাকি? তাজ্জব হওয়ার কিছুই নেই। কানাডিয়ান-এস্তোনিয়ান মনোবিদ এন্ডেল টালভিং সাহেব কি বলেছেন জানো? ভদ্রলোক বলেন,
“Remembering is mental time travel”
– Endel Tulving
অর্থাৎ আমরা যখন অতীতের কোনো ঘটনাকে স্মরণ করি, আমাদের মস্তিষ্ক কিন্তু অতীতের একটা সময়ে আমাদেরকে নিয়ে যায়। আমাদের মস্তিষ্ক কিছুক্ষণ সেই অতীতের কোনো একটা সময়ের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে এবং আমরা সেই সময়কে ধারণ করে থাকি। কিভাবে আমরা রোজ রোজ মেন্টালি টাইম ট্রাভেল করতে পারছি, এবার বুঝা গেলো?
(Source: Flicker)
এবার চলে আসা যাক আসল কথায়। নতুন কোনো জায়গায় গিয়ে কখনো কি মনে হয়েছে যে জায়গাটা তোমার খুব পরিচিত? ক্লাসের নতুন কোনো টিচারকে দেখে কখনো মনে হয়েছে যে, সেই ব্যক্তিকে তুমি আগেও কোথাও দেখেছো? যদি তোমার কাছে কোনো সিচুয়েশন স্পট খুব পরিচিত মনে হয় কিন্তু কেন বা কিভাবে পরিচিত তা অজানা তোমার কাছে, তাহলে এই পুরো ব্যাপারটিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় “দেজাভ্যু।“ এটা মূলত ফ্রেঞ্চ শব্দ, যার অর্থ করলে দাঁড়ায় “ইতিমধ্যে দেখা হয়েছে।” বিজ্ঞানের ভাষায় দেজাভ্যু হচ্ছে “ পুনরায় দেখার অনুভূতি বা ফিলিং অফ রিকালেকশন।”
ছোট কোনো শিশুদের সাধারণত দেজাভ্যু হওয়ার উদাহরণ নেই। মানুষের ৮-৯ বছর না হওয়া পর্যন্ত দেজাভ্যু অভিজ্ঞতা হয় না। তরুণ বয়সে দেজাভ্যু হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, বয়স বাড়ার সাথে সাথেই অবশ্য এর সম্ভাবনা কমতে থাকে। সুতরাং বলা যায়, এই দেজাভ্যুর সাথে আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশের একটা সম্পর্ক রয়েছে।
অনেক মস্তিষ্কের বিশ্লেষক দেজাভ্যুকে আমাদের মনের আর ১০টা কল্পনার সাথেই তুলনা করেছেন এবং তারা মনে করেন, দেজাভ্যুর পুরোটাই মস্তিষ্কের কল্পনার একটা অংশ যা সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন। অন্যদিকে কিছু কিছু চিকিৎসাবিজ্ঞান দেজাভ্যু কখন হয়, কেন হয়, কিভাবে হয়- এই প্রশ্নগুলোর খুব গুছানো কিছু উত্তর দিয়েছে। সেসবের কিছু অংশ তুলে ধরা যাক,
১. দেজাভ্যু কাদের হয়?
একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১০০ জন মানুষের মধ্যে প্রায় ৯০ জনই জীবনে অন্তত একবার দেজাভ্যু উপলব্ধি করেছেন। তন্মধ্যে, ১৫-২৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের হার সবচেয়ে বেশি।
২. দেজাভ্যু কখন হয়?
(Source: Wasabi Publicity)
খুব পরিচিত কোন ধ্যানধারনা নিয়ে আমাদের মনে কখনো সন্দেহ জাগে না। এসব ক্ষেত্রে দেজাভ্যু খুব একটা হয় না। আমাদের মস্তিষ্ক নতুন কোনো পরিবেশের সাথে তাল মেলানোর সময়ই কখনো কখনো দেজাভ্যুর জন্ম দেয়। হতে পারে সেটা কোনো নতুন পরিস্থিতি, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজন ইত্যাদি। আবার ব্যতিক্রমও রয়েছে। দেখা যাবে, পরিবারের কারোর সাথেই তুমি নিজ রুমে বসে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের কোনো লাইভ ম্যাচ দেখছো, হঠাৎ করে তোমার মনে হবে “এই ম্যাচটা তো আমি আগেও দেখেছি, এই সোফায়ই বসে, এই সময়েই !”
৩. দেজাভ্যু কেন হয়?
(Source: It’s okay to be smart)
দেজাভ্যু হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। এক এক গবেষণায় এক এক রকম ফলাফল উঠে এসেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানের একটা যুদ্ধ বেজে যায় এই দেজাভ্যুর কারণ বর্ণনার সময়। মেডিকেল সায়েন্স যখন এই ঘটনাগুলোকে মস্তিষ্কের নানা কার্যক্রমের সাথে পেঁচিয়ে ব্যাখ্যা দেয়, ঠিক একই সময় সাইকোলজির গবেষকরা দেজাভ্যুকে নিছক কিছু বিচ্ছিন্ন কল্পনার মত দেখে। তবে কিছু নির্ভরযোগ্য অনুসন্ধান থেকে দেজাভ্যু ঘটে থাকার পেছনের কয়েকটি কারণ জানা সম্ভব হয়েছে।
মস্তিষ্কের অন্যমনস্কতা
আমাদের চোখের সামনে অনেক ঘটনা ঘটতে থাকে, প্রতি সেকেন্ডে। আমাদের মস্তিষ্ক এতটাই শক্তিশালী যে সেটি হাজারো সব স্মৃতি ধারণ করতে সক্ষম। কিন্তু তবুও ২-১টি ঘটনা আমাদের ব্রেইন সিস্টেমকে এড়িয়ে চলে যায়, যা পরবর্তীতে দেজাভ্যুর আকার ধারণ করে। আমাদের চোখের সামনে ৩টি ঘটনা পর পর ঘটলে ঘটনাগুলো আমাদের মস্তিষ্ক প্যারাইটাল লোব, টেম্পোরাল লোব, থ্যালামাসে প্রেরণ করে এবং একটা স্পর্শকাতর অনুভূতি তৈরি করে থাকে। কিছু সেকেন্ড পরপর আমাদের ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স ধীরে ধীরে মস্তিষ্কতে সবগুলো ঘটনা এক এক করে সিগন্যাল আকারে প্রেরণ করে। এসময় দেখা যায়, ঘটে যাওয়া ৩টি ঘটনার মধ্যে ২টির সিগন্যাল আমাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি গ্রহণ করতে পেরেছে এবং শেষ ঘটনাটির আংশিক সংকেত আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং এই শেষের ঘটনাটিই কয়েকদিন পর হয়তো দেজাভ্যু আকারে হাজির হয়।
(Source: Wonderopolis)
আমাদের পরীক্ষা হলে অনেক সময় এরকম হয়ে থাকে। দেখা যায়, পরীক্ষায় প্রশ্ন পাওয়ার পরই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর তোমার আয়ত্তে আছে। কিন্তু পরীক্ষার চলাকালীন কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর ভুলে যেতে শুরু করো কেননা তোমার ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স একসাথে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর তোমার মস্তিস্কে জড়ো করে।
সত্যি ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা
অনেক সময় আমাদের মনে হয়, এই ঘটনা আমাদের সাথে আগেও ঘটেছে। এমনটা ঘটলেই যে সেটা দেজাভ্যু, তা কিন্তু নয়। হতে পারে, সত্যি সত্যিই ঐ ঘটনাটা তোমার সাথে আগেও ঘটেছে কিন্তু তোমার যেহেতু তোমার মস্তিষ্ক সেটা মনে করতে পারছেনা, সুতরাং তুমি পুরো ঘটনাটিকেই দেজাভ্যুর ঘারে চাপিয়ে দিচ্ছো। অনেক সময় টিভিতে দেখা কোনো স্থানে বাস্তবে ভ্রমণ করার সময়ও এমনটা হয়। এসব মূলত দেজাভ্যুরূপী সত্যি ঘটে যাওয়া ঘটনা।
চোখ
দুটি হাত থাকা সত্বেও আমরা যেভাবে ডান হাতে সব কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, ঠিক তেমনি আমাদের দুটি চোখের মধ্যেও একটা চোখ শক্তিশালী অপরটির তুলনায়। কোনো বস্তু আমাদের চোখে ধরা পড়ার সময় প্রথমে শক্তিশালী চোখে বস্তুটি ধরা পড়ে এবং পরবর্তীতে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী চোখে। কোনো বস্তু দেখা মাত্রই আমাদের শক্তিশালী চোখ ভিজ্যুয়াল কর্টেক্সের মাধ্যমে মস্তিষ্কে তথ্য প্রেরণ করে দেয়। তার সামান্য পরপরই অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী চোখের পালা আসে এবং সেটিও একই কাজ করে। অর্থাৎ একটি বস্তুর জন্য আমাদের মস্তিষ্ক দু-দুটি সিগন্যাল গ্রহণ করছে। বিষয়টা কখনো কখনো ন্যানোসেকেন্ডের মধ্যে এতই দ্রুত হয় যে আমরা পুরো ব্যপারটিকে দেজাভ্যু বলে মনে হয়।
ঘুমের ঘাটতি
“যথেষ্ট ঘুমের ঘাটতি আমাদের মস্তিষ্ককে কুয়াশাচ্ছন্নের মত করে তোলে।”
আমাদের প্রতিদিনের রুটিনে যথেষ্ট ঘুমের ঘাটতিও অনেক ক্ষেত্রে ঘন ঘন দেজাভ্যুর আবির্ভাব ঘটে। ইউনিভার্সিটি অব সেইন্ট অ্যান্ড্রিউস এর সিনিয়র লেকচারার আকিরা ও’কনোর তার ব্লগে লিখেছেন, “মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সাথে আমাদের স্মৃতির একটা যুদ্ধ লেগে থাকে, যার ফলাফলই হচ্ছে দেজাভ্যু।” আমাদের প্রতিদিনের ঘুমের ঘাটতি থাকলে মস্তিষ্কের সাথে স্মরণশক্তির অসামঞ্জস্যতা বেড়ে চলে, সঙ্গে বেড়ে চলে দেজাভ্যু হওয়ার প্রবণতা।
পূর্ব জন্মের অভিজ্ঞতা
ঠিক এই জায়গায় এসেই বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙ্গে একেবারে চুরমার হয়ে যায়। বিজ্ঞান কখনোই পুনর্জন্মের বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারেনি, কিন্তু অনেক ধর্মে একাধিকবার মানুষ জন্ম নেয়ার বিশ্বাসকে সমর্থন করে থাকে। পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে এমন অনেক মনোবিদদের মতে, আমাদের আগের জন্মে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই আমরা পরের জীবনে দেজাভ্যু হয়ে ধরা দেয়। আমেরিকার স্বনামধন্য একজন মনোবিদ ডাক্তার জুডিথ ওরলফ তার রচিত এক ব্লগে একবার লিখেছিলেন যে,
“দেজাভ্যু হলো আমাদের এমন কিছু ঘটনা, যা আমরা আমাদের পূর্ব জীবনে ইতিমধ্যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।“
— ডা. জুডিথ ওরলফ
তার লেখা ব্লগটিতে তিনি অনেক তার এই থিওরির পিছনে অনেক উদাহরণ ও দিয়েছেন যা সত্যিই দেজাভ্যুর সমীকরণটিকে অনেক কঠিন করে তোলে। ব্লগটি পড়ে আসতে পারো এই লিংক থেকেhttps://drjudithorloff.com/intuition-training-3-the-experience-of-deja-vu/
৪. দেজাভ্যু কিভাবে হয়
কোনো ঘটনা আমাদের সামনে চলে আসার সাথে সাথে আমাদের চোখ পুরো ঘটনার একটা ছবি বার্তা আকারে আমাদের মস্তিষ্কের পেছনের অক্সিপিটাল লোবে প্রেরণ করে, যেখানে আমাদের ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স অবস্থিত। এখানেই আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সবকিছুর প্রক্রিয়া ঘটে থাকে। তবে ভিজ্যুয়াল কর্টেক্সে যাওয়ার আগে সবগুলো স্মৃতি আরো অনেকটুকু সংবেদনশীল রাস্তা পেরিয়ে আসে। এসময়ই আমাদের স্মৃতি বিচ্যুতি ঘটে, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় “মেমোরি ডিস্টরশন”। আর এই মেমোরি ডিস্টরশনই হচ্ছে এই পুরো দেজাভ্যু ব্যাপারটার মূল আসামি। অন্যদিকে দেজাভ্যু কিভাবে হয়ে এ প্রসঙ্গে অনেকে বিশ্বাস করে যে- দেজাভ্যু কিভাবে হয় এর কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নেই, কারণ এটি মানবজাতির প্রতি সৃষ্টিকর্তার একটি আধ্যাত্মিক উপহার।
(Source: Wikimedia)
অনেক ছোটবড় রিসার্চ দেজাভ্যু সম্পর্কে আমাদের আরো কিছু মজার তথ্য দেয়। যেমন:
- দেজাভ্যু মূলত আমাদের “ইনার সেলফ” এর একটা সংকেত, যা আমাদের জানাতে চায় যে আমরা জীবনে সঠিক পথে এগোচ্ছি।
- তুমি যদি একাধিক ইউনিভার্সের মতবাদে বিশ্বাসী হও, তাহলে দেজাভ্যু অনেকটা পদার্থবিজ্ঞানের টিউনিং ফর্ক ফেনোমেনন এর মত। সহজ কথায়, পুরো ব্যাপারটা অনেকটা ক্রিস্টোফার নোলানের “ইন্টারস্টেলার” মুভির ন্যায়। মুভির শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, অতীতের ছোট্ট মার্ফের সাথে তার বাবা কুপার ভবিষ্যতে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ডাইমেনশন থেকে যোগাযোগ করছে। এখন দেজাভ্যুর ক্ষেত্রে বিষয়টা হচ্ছে, যদি কখনো তোমার দেজাভ্যু হয় তখন এমনটাও হতে পারে ভবিষ্যৎতের অন্য একটি ডাইমেনশন থেকে কোনো সত্ত্বা তোমার অতীত ও ভবিষ্যতের স্মৃতি নিয়ে যোগসাজশ করছে। ব্যাপারটার যদিও কোনো বাস্তব ব্যাখ্যা নেই, শুধুই বইয়ের পাতাতেই আবদ্ধ।
- আমরা শর্ট টাইম মেমোরি সম্পর্কে জানি। তেমনি দেজাভ্যু হচ্ছে লং টাইম মেমোরির একটি উদাহরণ।
- স্মৃতি বিচ্যুতি থেকে শুরু করে দেজাভ্যু- এরকম অনেক বিষয়ে আরো বেশি ধারণা পেতে চাইলে দেখে আসতে পারো দেজাভ্যু, ইনসেপশন, শাটার আইল্যান্ড, দ্যা ম্যাট্রিক্স এর মত অসাধারণ চলচ্চিত্রগুলো।
দেজাভ্যুকে নিয়ে প্রতিনিয়তই বাঘা বাঘা নিওরোলোজিস্ট, মনোবিদ, চিকিৎসকেরা বিস্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে কেউই সম্পূর্ণ নির্ভুল কোনো সমাধান দিতে পারেননি। তবে উপরের লেখাটা দেজাভ্যু সম্পর্কে তোমাদের জানার আকাঙ্ক্ষা অনেকটাই পূরণ করবে বলে আশা করছি।
—
সূত্র:
https://www.god-helmet.com/wp/dejavu.htm
https://theconversation.com/explainer-what-is-deja-vu-and-why-does-it-happen-11355
আপনার কমেন্ট লিখুন