প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিয়েরা লিওন; image source: lonelyplanet.com
সিয়েরা লিওনের সমুদ্র তীরবর্তী এক শহর
পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ ব্যতীত আরো একটা দেশ আছে যাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশটি সিয়েরা লিওন। বাংলাদেশ থেকে ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের এ দেশে বাংলা ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে।
কোর্সটিতে যা যা পাচ্ছেন:
বিসিএস প্রিলি লাইভ কোর্স
সিয়েরা লিওনকে বলা হয় ‘হীরার খনির গরিব দেশ’। অসংখ্য খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ হলেও এ দেশের মানুষ খুবই দরিদ্র ও অসুখী। দীর্ঘদিন এখানে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। এ উপনিবেশটি গড়ে তোলা হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুক্ত ক্রীতদাসদের নিয়ে। এরা সবাই ছিলো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। ১৯৬১ সালে সিয়েরা লিওন ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বর্তমানে সিয়েরা লিওনের সাংবিধানিক নাম সিয়েরা লিওন প্রজাতন্ত্র। সিয়েরা লিওন পশ্চিম আফ্রিকায় আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত। যার আয়তন ৭১ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার আর জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। সিয়েরা লিওনে বাস করে ১৬টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, যাদের সবার নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি আছে। ১৬ টি জাতিসত্তার বসবাস হলেও তাদের মধ্যে দুটি বৃহত্তম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী হল তেমনে ও মেন্দে সম্প্রদায়। সিয়েরা লিওনের উত্তরাঞ্চলে তেমনে জাতিগোষ্ঠীর প্রাধান্য রয়েছে, অপরদিকে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে মেন্দে জাতিগোষ্ঠী কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ধর্মীয় সহিষ্ণু জাতি হিসাবে সিয়েরা লিওন এর ব্যপক সুনাম রয়েছে। সিয়েরা লিওনে মোট জনসংখ্যার ৬০% মুসলিম, ৩০% আদিবাসী বিশ্বাসী এবং ১০% খ্রিস্টান ধর্মালম্বী। সিয়েরা লিওন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ধর্মালম্বীরা যথেষ্ট প্রভাবশালী। সিয়েরা লিওনে সকল ধর্মের মানুষেরাই একে অপরের প্রতি সহযোগী ও শান্তিপূর্ণ আচরণ করে। তাই সিয়েরা লিওনে ধর্মীয় সহিংসতা কখনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় নি। কিন্তু সিয়েরা লিওনের মানুষদের মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গৃহযুদ্ধ।
১৯৬১ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর পরই ১৯৬৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর দুর্নীতি, অপশাসন ও অযোগ্যতার কারণে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এর ফলে ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এক দশকের ও বেশি সময় ধরে ২০০১ সাল পর্যন্ত চলে ধ্বংসযজ্ঞ। এ গৃহযুদ্ধের ফলে সংঘটিত হয় গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুন্ঠন। ফলে সিয়েরা লিওনের রাজনৈতিক পরিবেশ চরমভাবে অশান্ত হয়ে উঠে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো সিয়েরা লিওনের অভ্যন্তরীণ এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলেও শেষে তা ব্যর্থ হয়। ১৯৯৬ সালে সরকার ও বিদ্রোহী সংগঠনের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ১৯৯৭ সালে বিদ্রোহী সংগঠন শান্তি চুক্তি ভঙ্গ করলে আবার শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। নির্বাচিত সরকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিরসনের জন্য বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ কামনা করে, যা সহিংসতাকে আড়ো বাড়িয়ে দেয়।
অবশেষে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয়। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয় সিয়েরা লিওনের শান্তি ফিরিয়ে আনার। বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ থেকে সিয়েরা লিওনে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সৈন্য পাঠায়। বাংলাদেশ থেকে প্রথমে ৭৭৫ জন সদস্যের সেনাবাহিনীর একটি দল সিয়েরা লিওনের দক্ষিণ অঞ্চলে লুঙ্গি নামক স্থানের দায়িত্ব নেয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে আরও সেনা সদস্য সিয়েরা লিওন যান এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার ৩০০ জন সেনা একত্রে সিয়েরা লিওনে কর্মরত ছিলেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ দল ২০০৫ সালে ফিরে আসে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বমোট প্রায় ১২ হাজার সেনা সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালন করেন।
আরও পড়ুন:
দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির ১১টি উপায়
হুমায়ূন আহমেদের যে বইগুলো না পড়লেই নয়
সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না। এক দশকের ও বেশি চলমান গৃহযুদ্ধে যে দেশ ধবংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছিল কেউ ভাবেতে পারেনি সে দেশে শান্তি ফিরে আসবে এবং সে দেশের মানুষদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সেই অসাধ্য কাজটিই বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের নিয়মিত সামরিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার জন্য বিবাদমান বিভিন্ন জাতির মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সাধারণ সেনারা ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও ব্যবহার করতে থাকেন। এমনিতে সিয়েরা লিওনে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে সরকারি প্রশাসন ও বিদ্যালয়সমূহে ইংরেজীতে কথা বলা হয়, তবুও দেশে এবং দেশের সকল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিও ভাষা সবচেয়ে বেশি কথ্য ভাষা। বিশেষ করে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য এবং একে অপরের সাথে সামাজিক যোগাযোগে ক্রিও ভাষা ব্যবহার করে। এসবের পাশপাশি এক নতুন ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠে সিয়েরা লিওনের মানুষেরা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সিয়েরা লিওনের লোকেদের কাছে শান্তি দূত হিসেবে এসেছিলেন যেন। সেনা সদস্যদের মুখের বাংলা ভাষা কেও সিয়েরা লিওনের সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে খুব আগ্রহের সঙ্গে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধৈর্যের সাথে তাদের বাংলা ভাষা শেখাতে শুরু করেন। ভাষার পাশাপাশি সিয়েরা লিওনের মানুষেরা পরিচিত হয়ে উঠে বাঙালি সংস্কৃতির সাথেও। লক্ষ্য করা যায়, যেসব অঞ্চলে বাংলাদেশি সেনা সদস্য রা ছিল, সেখানেই স্থানীয়রা বিশেষত তরুণ-তরুণীরা বাংলায় কথা বলতে পারে। সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রমে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী যুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন সামাজিক সভায় ও স্থানীয়রা বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয়দের বাঙালি নাচ ও গান পরিবেশন করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ সেনাদলের কল্যাণে সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষা ব্যপক জনপ্রিয়তা পায়। স্থানীয়রা কাজ চালানোর মতো বাংলা ভাষা শিখে নেওয়ার ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশ পুনর্গঠনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্য দেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী দের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামাজিক ও সেবামূলক কার্যক্রমের ফলে বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের ভালোবাসতে শুরু করে সিয়েরা লিওনের সাধারণ লোকেরা। সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠা্র জন্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মোট ৩১টি দেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী কর্মরত ছিল। প্রায় প্রতিটি দেশের সেনা সদস্যদের উপর বিভিন্ন সময়ে সিয়েরা লিওনের যুদ্ধরত বিভিন্ন বিদ্রোহী দলের আক্রমণের ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ সেনা বাহিনী ছিল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপর এমন হামলার নজির পাওয়া যায় না কারণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সিয়েরা লিওনের সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল। মূলত এ কারণেই বাংলা ভাষা স্থানীয়দের মধ্যে ব্যপক আকারে প্রচার ও প্রসার পায়।
২০০২ সালের দিকে শান্তি ফিরে আসে সিয়েরা লিওনে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সিয়েরা লিওনের শান্তি রক্ষায় ও যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনে যে ভূমিকা রেখেছে, তার জন্য সিয়েরা লিওন সরকার ও সাধারণ নাগরিকেরা কৃতজ্ঞ। দেশে শান্তি ফিরে আসার পর পরই সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট আহমাদ তেজান কাব্বাহ কৃতজ্ঞতা জানাতে একটুও দেরি করেন নি। তিনি বাংলাদেশি সেনা সদস্যদের ভূমিকাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বাংলা ভাষাকে দেশটির সরকারি ভাষার মর্যাদা দেন। শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশ গঠনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নির্মিত ৫৪ কিলোমিটার সড়ক উদ্বোধনকালে প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বা বাংলা ভাষাকে সিয়েরা লিওনের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি ওলুয়েমি আদেনজি, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল ড্যানিয়েল ইসমায়েল সহ আরও অনেকে। বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট কাব্বা ২০০৩ সালের ২১ অক্টোবর তিন দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে আসেন।
এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের পর অন্য কোন রাষ্ট্রে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি ও মর্যাদা পায়। তবে পরবর্তীতে সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষা প্রচার, প্রসার কিংবা সংস্কৃতির আদান প্রদানে সরকারি ভাবে কোন পদক্ষেপ নেয় নি বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু আজো সিয়েরা লিওনের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের মুখে শোনা যায় বাংলা ভাষা। সিয়েরা লিওনের মানুষেরা এখনো স্মরণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান কে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা যখন বাংলায় গেয়ে উঠি, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাংগানো একুশে ফেব্রুয়ারি………” সে মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সম্পূর্ণ পৃথক সংস্কৃতির এক দেশে কেউ বাংলায় কথা বলে ওঠে।
আমাদের কোর্সগুলোর তালিকা:
- Communication Masterclass by Tahsan Khan
- Facebook Marketing Course by Ayman Sadik and Sadman Sadik
- ঘরে বসে Freelancing by Joyeta Banerjee
- ঘরে বসে Spoken English Course by Munzereen Shahid
- Study Smart Course by Seeam Shahid Noor
- Microsoft Office 3 in 1 Bundle
- Microsoft Word Course by Sadman Sadik
- Microsoft Excel Course by Abtahi Iptesam
- Microsoft PowerPoint Course by Sadman Sadik
আপনার কমেন্ট লিখুন