শিক্ষার্থীদের যদি প্রশ্ন করা হয় – “ছাত্রজীবনে কোন জিনিসটি না থাকলে সবচেয়ে ভালো হতো?”, তাহলে যে উত্তরটি বেশির ভাগের কাছ থেকে আসবে সেটি হল – “পরীক্ষা”। কবি সুকান্তের আঠারো বছর বয়সী বিরাট দুঃসাহসীরাও মুষড়ে পড়ে এই পরীক্ষার সামনে।
পরীক্ষার প্রতি এই ভয় বা দুশ্চিন্তা কিন্তু অনেকটাই স্বাভাবিক। পরীক্ষার সময় মানুষ যে মানসিক চাপ অনুভব করে তা নিঃসরণ ঘটায় অ্যাড্রেনালিন, কর্টেসোল সহ অন্যান্য স্ট্রেস হরমোনের। এই স্ট্রেস হরমোন মস্তিষ্ককে “ফাইট অর ফ্লাইট” রেস্পন্সের সংকেত দেয়। এজন্যই পরীক্ষা আসলে আমাদের ভয় শুরু হয়ে যায়।
২০১৫ সালে প্রায় ১৩০০ পরীক্ষার্থীর ওপর “চাইল্ডলাইন” নামক এক সংস্থার চালানো জরিপে দেখা যায় – ৯৬% পরীক্ষার্থী বিভিন্ন মাত্রায় পরীক্ষা ভীতিতে আক্রান্ত। তাহলে দেখতেই পাচ্ছ, পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় ঘুম চলে যাওয়ার দলে তুমি একা নও।
তবে, পরীক্ষার প্রতি ভয় বা উদ্বেগ আবার সবার ক্ষেত্রে একরকম হয় না। পরীক্ষাভীতি যখন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়, তখনই তা অনেক ধরনের ক্ষতিকর লক্ষণ দেখায়। যেমন – মনোযোগের ঘাটতি, পরীক্ষার হলে সব ভুলে যাওয়া, ডিপ্রেশন, অস্থিরতা, অসুস্থতা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি। পরীক্ষার অস্বাভাবিক উদ্বেগকে কিন্তু সহজেই স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। আর, সেটি তুমি করতে পারবে এই ৫টি উপায়ের মাধ্যমে –
১। পরীক্ষা নিয়ে ইতিবাচকতা:
পরীক্ষা ভীতির অন্যতম বড় কারণ আত্মবিশ্বাসের অভাব। অনেক সময় ভালো প্রস্তুতি নিয়েও শুধু আত্মবিশ্বাসের অভাবে পরীক্ষা খারাপ হয়। তাই, পরীক্ষা ভীতির বিরুদ্ধে তোমার প্রথম অস্ত্র হবে – নিজের প্রতি এক ইতিবাচক মনোভাব।
বিশ্বাস করতে হবে যে, তুমি পারবে। নেতিবাচক চিন্তাগুলো- যেমন , ‘এই বিষয়ে তো আগে আমি সবসময় খারাপ করেছি! এবারও করবো!’ – এ সবকিছু একেবারেই ঝেড়ে ফেলো মাথা থেকে। সঙ্গে পরীক্ষায় খারাপ করলে কী কী হবে, সে চিন্তাও।
পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে চেষ্টা করবে সেই সব বন্ধুদের সাথে কথা না বলতে, যারা সবসময় নেতিবাচকতা নিয়ে চলে। কারণ, ভয় ও দুশ্চিন্তা সংক্রামক। প্রশ্ন উত্তরের সময় এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর সবার আগে দেবে, যেগুলো তুমি অনেক ভালো পারো। এই কৌশল তোমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে কয়েকগুণ।
স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রে কৃপণতা কখনই করবে না। তবে হ্যাঁ, এটা মাথায় রেখো – তোমার আশা যাতে তোমার ওপরই অতিরিক্ত চাপের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।
২। মেডিটেশন:
ধ্যান বা মেডিটেশন অস্থিরতা দূর করতে অসম্ভব কার্যকর। মেডিটেশন তোমার দুশ্চিন্তা দূর করে মস্তিষ্ককে ঠান্ডা করবে এবং মনোযোগ বৃদ্ধি করবে। মেডিটেশনের পাশাপাশি Breathing Exercise (যেটিকে দমচর্চা বা প্রাণায়ামও বলা হয়) একই রকম ফলপ্রসূ।
একটা সাদা কাগজ নাও এবং লিখে ফেলো কেন তুমি ভয় পাচ্ছো সেই পরীক্ষা নিয়ে।
মেডিটেশনের নাম শুনলেই আমাদের মাথায় ভেসে ওঠে বৃন্দাবনে ধ্যানরত কোনো সাধুর ছবি। ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। মেডিটেশন শিখতে তোমাকে বনবাসে বা হিমালয়ে যেতে হবে না। ইউটিউব বা প্লে স্টোরেই রয়েছে অনেক অ্যাপ যার মাধ্যমে তুমি সহজেই ধ্যানচর্চা করতে পারবে। যেমন – Quantum Meditation, Headspace, Calm ইত্যাদি।
আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক অনুশীলন তুমি করতে পারো। সেটি হল – চোখ বন্ধ করে তোমার সবচেয়ে প্রিয় সময় বা অভিজ্ঞতার কথাটি ভাবো। তারপর নিজেকে কল্পনা করো পরীক্ষার হলে। পরীক্ষার হলে বসে তুমি খুব সুন্দর ভাবে প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর লিখে যাচ্ছো।
এই মানসিক অনুশীলনে সুখকর অভিজ্ঞতার সাথে পরীক্ষার দুশ্চিন্তার সম্মিলন ঘটে। ফলে, দুশ্চিন্তা বা ভয় হ্রাস পায় অনেকাংশে।
৩। ভয়গুলোকে লিখে ফেলা:
পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে এক কাজ করো। একটা সাদা কাগজ নাও এবং লিখে ফেলো কেন তুমি ভয় পাচ্ছো সেই পরীক্ষাটি নিয়ে। কিছু কিছু কারণ অনেক হাস্যকর এবং হালকা মনে হতে পারে, তবুও প্রতিটি কারণই লিখে ফেলো। তারপর ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দাও সেই কাগজটা।
এই মনস্তাত্ত্বিক কৌশলটির ওপর ২০১১ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। সে গবেষণায় দেখা যায়, এই কৌশল শুধুমাত্র পরীক্ষা ভীতিই কমায় না, পরীক্ষার রেজাল্টেরও অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটায়।
৪। খাবার:
পরীক্ষার সময় আমাদের দৈনন্দিন রুটিনের বারোটা বেজে যায়। যার প্রভাব পড়ে খাদ্যাভ্যাসেও। এই খাদ্যাভাস কিন্তু অনেক ভাবেই আমাদের পরীক্ষাভীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ, আমাদের গ্রহণকৃত খাদ্য সরাসরি আমাদের মানসিক অবস্থায় প্রভাব ফেলে।
উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবারের বদলে আমাদের গ্রহণ করা উচিত কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার সম্পন্ন খাবার। কারণ, এসব খাবার পরিপাক হয় ধীরে ধীরে। তাই, মস্তিষ্ক একাগ্রতা ধরে রাখতে পারে। এই মনোযোগ বা একাগ্রতার অভাবই আমাদের পরীক্ষাভীতির অন্যতম কারণ।
৫। ঘুম:
পরীক্ষার আগের রাতে আমাদের পরীক্ষাভীতি উঠে যায় একেবারে এভারেস্টের শিখরে। মনে হয় – “হায় হায়! কিছুই তো পারি না”। তখন আমরা হুড়মুড় করে সব পড়তে যাই এবং বিসর্জন দেই ঘুমকে। চিন্তা করি – “৩৬৪ রাত তো ঘুমিয়েছি, একরাত না ঘুমালে আর কী হবে?”
এটি কিন্তু অনেক বড় একটি ভুল। স্বাভাবিকভাবে, একজন মানুষের ৭-৮ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন। সেটি সম্ভব না হলে কমপক্ষে ৬ ঘন্টা ঘুম পরীক্ষার আগের রাতে খুব জরুরি। পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের মস্তিষ্ক থেকে স্ট্রেস হরমোনগুলো দূর করে আমাদের দুশ্চিন্তাকে কমিয়ে আনে। সেই সাথে মস্তিষ্ক তার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তিও শানিয়ে নেয় ঘুমের মাধ্যমে।
যদি আমরা অন্যভাবে চিন্তা করি, পরীক্ষা আসলে আমাদের জন্য একটি সুযোগ নিজেদের প্রমাণ করার। তাহলে, শুরু হয়ে যাক পরীক্ষার ভয়কে জয় করার লক্ষ্যে তোমার যাত্রা।
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com/admissions/live/
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন