তৃতীয় পর্বের শেষের দিকে একটি ক্যামেরার কথা বলেছিলাম, মনে আছে? ঐ যে, যে ক্যামেরার মাধ্যমে নীলের চাঁদে নামার ঐতিহাসিক মুহূর্তকে ধারণ করা হয়। এই ভিডিও নিয়ে আরো কাহিনী আছে।
নিচের ভিডিওটি একটু দেখে নিন, তারপর ব্লগে ফিরে আসুন।
শ্যুটিং করতে গিয়ে ধরা খেলো নাসা তাই না? তারপর এই ভেঙে যাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে এডিট করে চন্দ্রাভিযান নামে চালিয়ে দিয়ে পৃথিবীবাসীকে মিথ্যে ধোঁকা দেয় ক্ষমতাধর রাষ্ট্র! এইতো? থামুন। যুক্তিতে আসুন। চলুন তবে আজকের পর্বে এই ভিডিওটির ব্যাখ্যা দিয়ে মূল কন্সপিরেসী থিওরীগুলোতে হাত দেই।
ভিডিওটি পাওয়া যায় moontruth.com নামক ওয়েবসাইটে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন নীল নামার সময় যখন one giant leap বলতে যাবে ,তখনই লাইটিং সেট ভেঙে পড়ে এবং শেষ দিকে মজা করে তিনি বলেন ‘Sorry, Mr Gorsky’। কিন্তু আসলটি ছিল ‘Good Luck, Mr Gorsky’। যাই হোক আসল কথায় আসি। ভিডিওতে লক্ষ্য করে দেখবেন নীল বলছে ‘One small step for man’।
লক্ষ্য করুন-
এটা যদি নাসার শ্যুটিং করা ভিডিও হতো, তবে কি এই সহজ ইংরেজী ব্যাকরণ ভুল করতো? আপনাদের একটি তথ্য দিয়ে রাখি। চাঁদে নামার সময় ভয়ার্ত এবং একই সাথে বিশ্বজয়ের উত্তেজনা ও শুষ্ক গলায় নীল একই রকম ব্যাকরণে গড়মিল লাগিয়েছিলেন। আবার এই ভিডিওতেও তিনি একই ব্যাকরণ ভুল করেন। অর্থাৎ ‘step for (a) man’ বা a বাদ পড়ে যায়। এটি নাসার শ্যুটিং হলে অবশ্যই ‘কাট’ বলে আবার আরেকটি শট নিয়ে ব্যাকরণটা ঠিক করে নিত, তাই না? সহজ হিসাব!
আচ্ছা আমার হিসাব বুঝার দরকার নেই, প্রমাণে আসি।
অনেকেই আমার কাছে রেফারেন্স দাবি করেন। আচ্ছা তবে এই ভিডিওটি যে ফেইক তা ঐ ওয়েবসাইট থেকেই জানানো হয়। প্রমাণ চান?
দেখে নিন: http://web.archive.org/web/20030610181152/moontruth.com/full.htm
এখানেই এই ভিডিও বানিয়ে মিথ্যাচার ছড়ানোর আসল ইতিহাস তারা নিজেরাই স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে, যদিও তার আগেই ‘পতাকা ওড়ে কেন’ আমজনতার কাছে বেশ প্রিয় হয়ে যায় ভিডিওক্লিপটি। শেষের দিকে আবার বলেছে ‘’এই ভিডিও ফেইক মানে এই নয় যে তারা চাঁদে গিয়েছে’’। ৪র্থ পর্বে এসেও পাঠকরা বুঝতে পারছেন যে এই কন্সপিরেসী থিওরীর শিকড় কতোটা গভীর এবং শক্তিশালী! সবদিকেই বেশ শক্ত ভিত স্থাপন করেছে।
চলুন আমরা বরাবরের মতো কন্সপিরেসী থিওরীগুলোতে নজর বুলাই এবং তা সমাধানের চেষ্টা করি।
এত বড় গাড়ি অ্যাপোলো নভোযানে কীভাবে জায়গা করে নিলো? নাসা শ্যুটিং করার আগে একবারও ভাবেনি?
বেশ চিন্তার কথা তো! আচ্ছা চলুন সেই গাড়িটি আগে দেখি।
অ্যাপোলো নভোযানগুলো খুব বড় ছিল না। কোনোরকম দুই নভোচারীকে জায়গা করে দিয়ে বাকি জায়গা বরাদ্দ ছিল সংগ্রহ করা শিলা, লুনার রোভার, ব্যাকআপ স্পেসস্যুট, টেলিস্কোপ, ক্যামেরা ইত্যাদি রাখার জন্য। আমরা আগে লুনার রোভারটি সম্পর্কে একটু অল্পস্বল্প ধারণা নিয়ে নেই।
এর আরেক নাম আছে, Moon Buggy। আবার Dune Buggy নামেও এটি বেশ পরিচিত। ২১০ কেজি ওজনের লুনার রোভারটি চাঁদের দেশে ৩৫ কেজি হয়ে চলার পথে পাউডারের ন্যায় মাটিগুলো উড়িয়ে জানান দিচ্ছিল ৩৯ মিলিয়ন ডলারের গাড়িটি ভীনদেশে এসে বেঈমানি করেনি! রোভারটি ছিল দুই সীটের, তবে সীটগুলো ভাঁজ করা যায়। অর্থাৎ উপরের দিকে যা কিছু দেখতে পাবেন তা সবই ভাঁজ করে রাখা যায়।
আবার চাঁকাগুলোও ফোল্ডিং করে ডিসেন্ট স্টেজে সহজেই জায়গা করে রাখা যায়। তাহলে সব ভাঁজ করে এই লুনার রোভারটিকে দেখতে কি নভোযানটির চেয়েও বড় হবে? আপনারাই বলুন!
বোয়িং-এর বানানো এই রোভারগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল শুধুমাত্র অ্যাপোলো ১৫, ১৬ এবং ১৭ মিশনে। অ্যাপোলো ১৫ মিশনে সেইসময় অবতরণ স্থল থেকে ১৭ মাইল পর্যন্ত যেতে সক্ষম হলেও অ্যাপোলো ১৬ মিশনে নভোচারীরা এই রোভার দিয়ে ১৬.৮ মাইল যেতে পারে। তবে সর্বশেষ অ্যাপোলো ১৭ মিশনে ক্যার্নান এবং শ্চিমিট প্রায় ২২.৫ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে শেষ রেকর্ড গড়ে তুলেন যেখানে গতি ছিল ঘণ্টায় ১১.৫ মাইল!
তাহলে এই বিতর্কেরও অবসান ঘটলো! পরের কন্সপিরেসী থিওরীতে প্রবেশ করি।
Crosshair!!!
বুঝিয়ে বলি। ক্রসহেয়ার হচ্ছে ক্যামেরায় স্থাপন করা একটি “+” চিহ্নিত দাগ যা পূর্বের পর্বগুলোতে দেয়া প্রতিটি ছবিতেই আপনারা দেখতে পাবেন। তবে এই ক্রসহেয়ারগুলো ছবিতে তখনই প্রদর্শিত হবে যখন তা প্রিন্ট করে বের করা হবে। এটা ক্যামেরা সেটিংসেরই একটা অংশ যা ছবি থেকে মুছে দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটি Réseau Plate বা রেসিউ প্লেট-এর একটি অংশ। রেসিউ প্লেটটি গ্লাস বা প্লাস্টিকের একটি স্বচ্ছ শীট, যা ফুডিউশিয়াল মার্কার নামে ক্রসহেয়ারগুলো একটি গ্রিডের সাথে খোদাই করা অবস্থায় থাকে। এটি বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত ফটোগ্রাফির জন্য সাধারণত ফিল্ম ক্যামেরায় (ডিজিটাল মিডিয়া যুগের বহু আগে) ব্যবহৃত হয়। প্লেটটি ক্যামেরার ফোকাল প্লেনে স্থাপন করা হয় যা শুধু ফিল্মের সামনে অবস্থিত।
এই ক্রসহেয়ার নিয়ে তাহলে সমস্যা কোথায়?
সমস্যা আমি তৈরি করিনি। করেছে কন্সপিরেসী থিওরীস্টরা। কীভাবে? নিচের ছবিটি ভালোভাবে লক্ষ্য করুন তারপর আমরা ব্যাখ্যায় যাচ্ছি।
কন্সপিরেসী থিওরীস্টরা দাবি করেন যে এই ছবিগুলো এডিট করা। নাহলে কিছু কিছু অংশে ক্রসহেয়ারগুলো ছবির পেছনে চলে গিয়েছে কীভাবে? তা তো ছবির সামনেই থাকার কথা। নাসা হয়তো তড়িঘড়ি করে এডিট করে ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে, খেয়াল করেনি! এই হলো উদ্ভট যুক্তি! তবে উপরের ছবিগুলোতে যে ক্রসহেয়ারের কিছু অংশ একদিকে দেখা যাচ্ছে এবং অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে না, তা আমি অস্বীকার করছি না। যা দৃশ্যমান, তা মিথ্যা না। তবে বুঝতে হবে এর পেছনে কারণ।
আসলে ছবিগুলো সব লোয়ার ইমেজ কোয়ালিটির, যেখানে একটি নির্দিষ্ট রঙের সাথে ক্রসহেয়ারগুলো মিশে গিয়েছে।
যেমন দেখুন:
ছবিতে সাদা অংশের দিকে এসে ১০০ মাইক্রোমিটার প্রশস্তের ক্রসহেয়ারটি মনে হচ্ছে মিশে গেছে বা বস্তুটির পেছনে চলে গিয়েছে (অবিশ্বাসীদের দাবি, নাসা অসাবধানবসত এডিট করতে গিয়ে ভুল করেছে)। আসলে এটা খুবই সাধারণ মানের স্ক্যান যেখানে সাদা অংশের উজ্জ্বলতা বেশি। নিচের ছবিটি দেখলেই বুঝতে পারবেন।
এখন পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা?
আরো দেখাই:
দেখুন চাঁদের মাটিতেও ক্রসহেয়ারগুলো তেমন স্পষ্ট নয়। কিন্তু নিচের ছবিটি আরো ভালোভাবে স্ক্যান করা:
পরিষ্কার হয়েছে?
ল্যাবে পরীক্ষা করার সময় একইভাবে অতিরিক্ত উজ্জ্বলতা এবং এক্সপোজারের কারণে ক্রসহেয়ারটির কিছু অংশ গায়েব বলে মনে হচ্ছে:
ইমালশান অ্যাপারচারের কারণে কালো রঙের বস্তুটির মিশে যাওয়া খুবই সাধারণ একটি বিজ্ঞান। স্টুডিওতে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে শুধু সাদা নয়, ধূসর রঙের কাছেও এই ক্রসহেয়ার হার মেনেছে। ভিডিওটি আপনাকে আরো ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করবে বলে আমার বিশ্বাস:
তাহলে নাসা ছবি এডিটের অপবাদ থেকে মুক্তি পেল তো? না, এই ক্রসহেয়ার নিয়ে আরো একটি অপবাদ বয়ে বেড়িয়েছে নাসা।
বাঁকা ক্রসহেয়ার!
উপরে অলড্রিনের নামার মুহূর্তের দুটি ছবি দিয়েছি, প্রথম ছবিটি আবার একটু লক্ষ্য করুন। ক্রসহেয়ারগুলো পরখ করুন, আবার দ্বিতীয় ছবিতে তাকান, কোনো পার্থক্য চোখে পড়ছে কি? প্রথম ছবিতে ক্রসহেয়ারগুলো সোজা, কিন্তু দ্বিতীয় ছবিতে তা বাঁকানো। কন্সপিরেসী থিওরীস্টরা এখানেও চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে। যাই হোক মূল ঘটনা হচ্ছে দ্বিতীয় ছবিটি ক্রপ করে রোটেট করা। এরকম অনেক ছবি কপি হতে হতে কেউ কেউ ক্রপ করে রোটেট করেছে হয়তো ভালো দেখার কারণে। সুতরাং, চন্দ্রাভিযানে বিশ্বাস না করার এটি খুবই তুচ্ছ একটি কারণ!
তাহলে ক্রসহেয়ার নিয়ে আমরা আর নাসার চন্দ্রাভিযানকে ক্রসফায়ার না করি, কেমন? চলে যাই আজকের শেষ অভিযোগে।
হটস্পট!
কিছু ছবিতে নভোচারীদের স্পেসস্যুট বা আশপাশে এমন কিছু উজ্জ্বল আলো দেখা যায়, যা একমাত্র বড় স্পটলাইটের উপস্থিতি ছাড়া ভিন্ন কিছুই নির্দেশ করে না। এই কন্সপিরেসী থিওরীটা বেশ গভীরের। তবে সমাধান সহজ। ছবিটির দিকে তাকান:
স্পেসস্যুটটি মনে হচ্ছে একটু বেশিই উজ্জ্বল! আবার পেছনের একটি পাথরও বেশ অস্বাভাবিক ভাবে উজ্জ্বল, মনে হচ্ছে খুব কাছেই একটি বড় স্পটলাইটকে সূর্য বানিয়ে এরিয়া ৫১-এর কোনো এক জায়গায় শ্যুটিং করেছে নাসা। কিন্তু উপরের ছবিটি এডিটেড ভার্সন।
আসল ছবিটি হলো:
এই হচ্ছে আসল ছবি। এখানে কোনো স্পটলাইটের ইফেক্ট দেখা যাচ্ছে? না।
সমাধান আরো বাকি আছে।
আরেকটি ছবি লক্ষ্য করুন:
ছবিটি সম্ভবত অ্যাপোলো ১১ মিশনেরই, সঠিকটা মনে হচ্ছে না। ব্যাখ্যায় যাই। ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন ছায়ার মাথার অংশের চারদিকে উজ্জ্বল আলো, যেন এই ছবি দেখে সত্যিই মনে হবে পেছনে কোনো বড় স্পটলাইট হচ্ছে এরকম আলোর উৎস।
এক্ষেত্রে আপনাদেরকে একটি জার্মান শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, Heiligenschein। যা একটি দৃশ্যমান ইন্দ্রিয়গোচর ঘটনাকে নির্দেশ করে। এই সাধারণ আলো-আঁধারের খেলার জন্য বড় স্পটলাইটের প্রয়োজন পরে না। যদিও চাঁদে সূর্যের আলোর প্রতিফলন আপনি পৃথিবীর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি প্রত্যক্ষ করবেন। সূর্যের আলোর দ্বারাও যে এই সাধারণ ঘটনাটি সম্ভব তা নিচের ছবি দেখেই বুঝতে পারবেন।
বুঝতে পেরেছেন?
চাঁদের মাটিতে সূর্যের আলো ছাড়াও পৃথিবী থেকেও সূর্যের প্রতিফলিত আলো দেখতে পাবেন। তাছাড়া চাঁদের মাটি পৃথিবীর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি আলো প্রতিফলিত করতে পারে। আপনি চাঁদের মাটিতে রোদে দাঁড়িয়ে যদি একটি ছায়ার ছবি তুলতে যান, অবশ্যই আপনি ছায়ার চতুর্দিকে উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি দেখতে পাবেন যা একটি সাধারণ আলোকবিজ্ঞানের ঘটনা।
অ্যাপোলো ১২ মিশনের নভোচারী কনরাড ল্যান্ডিংয়ের সময় চিৎকার করে বলেন:
‘’Boy, that Sun is bright. That’s just like somebody shining a spotlight in your hand. I’ll tell you…You know, this Sun…It really is…It’s just like somebody’s got a super-bright spotlight’’
তাহলে স্পটলাইটের হটস্পট ইফেক্ট নিয়ে আরও কোনো সমস্যা রইলো কি? ইউটিউবে কোট-টাই পড়া অনেক জ্ঞানী বিজ্ঞানীর অ্যানালাইসিসে দেখবেন চাঁদের মাটিতে নামা নভোচারীদের হেলমেটে সূর্যের প্রতিফলিত আলো বেশ বড় দেখাচ্ছে যা কোনোভাবেই সম্ভব নয় স্পটলাইটের ব্যবহার ছাড়া। কিন্তু ঐ যে বললাম, বাতাসহীন পরিবেশে উজ্জ্বলতা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান রাখতে হবে।
তাহলে এই নিয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ রইলো না।
আজকের পর্ব এখানেই শেষ, পরের পর্বে একটু জটিল সমস্যার সমাধান করা হবে।
ধন্যবাদ।
১০ মিনিট স্কুলের লাইভ এডমিশন কোচিং ক্লাসগুলো অনুসরণ করতে সরাসরি চলে যেতে পারো এই লিঙ্কে: www.10minuteschool.com/admissions/live/
১০ মিনিট স্কুলের ব্লগের জন্য কোনো লেখা পাঠাতে চাইলে, সরাসরি তোমার লেখাটি ই-মেইল কর এই ঠিকানায়: write@10minuteschool.com
আপনার কমেন্ট লিখুন